ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোনদিকে এগোচ্ছে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ

রায়হান আহমেদ তপাদার
কোনদিকে এগোচ্ছে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ

চলতি বছরের ১৮ মে ঘোষণা করেছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দের স্থলে তার ডেপুটি মৌলভী আবদুল কবিরকে বসিয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, আখুন্দ অসুস্থ থাকায় দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ২০২০ সালে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে আবদুল কবির অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। কবিরের এই নিয়োগকে তালেবান সরকারের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে দাবি করা হলেও নিয়োগের সময়কালটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমকে এই বিষয়টি খুবই সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। শিক্ষায় মেয়েদের অন্তর্ভুক্তিকে সীমিত করে আনা এবং বিভিন্ন পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে তালেবান প্রশাসন যখন আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে, ঠিক সেই সময়ে এই ঘোষণা এল। নেতৃত্বের এই পরিবর্তনকে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি ও তালেবানের আরো দরাজ হওয়ার একটি আভাস হিসেবে দেখা যেতে পারে। তালেবানের অবস্থান থেকে সরে আসার পথে হয়তো তাদের অহংবোধ থেকে যাবে, কিন্তু তারা যে ছোট ছোট পরিবর্তন আনছে, তা পরিবর্তনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তালেবান শাসনের দুই বছর পর আফগানিস্তানে ভিন্ন ধরনের হলেও সমস্যার অন্ত নেই। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২ বছরের আলোচনা প্রচেষ্টার পর ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। চুক্তির পর পশ্চিমা সেনারা আফগানিস্তান থেকে সরে গেলেও আফগান সমাজের পুনকেত্রীকরণ হয়নি। এর বিপরীতে ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তালেবানকে সেখানে ভয় ও হুমকির পরিবেশের মধ্যে শাসন পরিচালনা করতে হচ্ছে। আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ স্বর্গে পরিণত হতে দেবে না বলে যে অঙ্গীকার তারা করেছিল, তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে তালেবান। যাহোক, এর ফলে তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি। সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলো আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা ও নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে রেল যোগাযোগের চিন্তা করছে। ২০২১ সালের বসন্তকালে তালেবানরা যে নাটকীয় ও তড়িত আক্রমণ শুরু করেছিল, তার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তালেবানের প্রত্যাবর্তন ও পশ্চিমাদের বিশৃঙ্খল পশ্চাৎপসারণের ঘটনাপ্রবাহ আফগানিস্তানের ওপর দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার দুঃখজনক শেষ পরিণতি। আফগানিস্তান এমন একটি দেশ, যারা আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং সেখান থেকেই তিনি নাইন/ইলেভেন-এর সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন। আফগানিস্তানের জন্য তালেবানের ফিরে আসার মানে হচ্ছে, একটা চরম অনুদার শাসনব্যবস্থার শুরু, যারা নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ভীষণ রকম বৈরী। তালেবান এত দ্রুত শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেছিল যে তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। আফগান সরকার খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু আর যেসব ঘটনা গত ২ বছরে ঘটেছে, তার বেশির ভাগই আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল। যেমন মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়া থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সংকট- এসব আগেই ধারণা করা গিয়েছিল। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার এ বছরের জুলাই মাসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২ বছরে ৫০ লাখ আফগান অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছেন, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরো ৩০ লাখ।

আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতি নজিরবিহীনভাবে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ১ কোটি ৮০ লাখ অর্থাৎ আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন। তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানে সহিংসতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যায়। এরপরও গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের সূচক অনুযায়ী, আফগানিস্তান বিশ্বের কম শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। আফগানিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসী হামলা বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়ার পেছনে প্রধানভাবে দায়ী আইএস। আফগানিস্তানের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে তারা শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে, আইএসকে আফগানিস্তানের উত্তর দিকের প্রতিবেশী মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একই রকম হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া এ বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আত্মঘাতী বোমা হামলার পেছনে আইএসকে দায়ী বলে দাবি করা হয়। ওই হামলায় ৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হন। যা হোক, আইএস পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি নয়। বরং, তালেবানের দীর্ঘদিনের মিত্র তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এখন পাকিস্তানের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির নিরাপদ স্বর্গ এখন আফগানিস্তান। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দলছুটদের একত্র করে টিটিপি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। তালেবান ক্ষমতায় আসায় পর, আঞ্চলিক আরো কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরো অবাধে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার পরিবেশ পাচ্ছে। এর মধ্যে ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান ও তুর্কেস্তান ইসলামিক পার্টি রয়েছে। এ ছাড়া আরো অংসখ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে। এসব গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা ১০ জন থেকে শুরু করে কয়েকশ’ জন পর্যন্ত। কিন্তু তারা একে অপরকে সহযোগিতা করতে আগ্রহী আর আইএস-এর মতো তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। এটা নির্দিষ্টভাবে চীনের জন্য উদ্বেগের কারণ। বেইজিং এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যে উইঘুর চরমপন্থিদের সংগঠন তুর্কেস্থান ইসলামিক পার্টি ভবিষ্যতে চীন ও পুরো অঞ্চলে চীনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্বার্থে হামলার জন্য আফগানিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সন্ত্রাসবাদের বাইরে অতিমূল্যবান পানিসম্পদ এখন সেখানে সংঘাতের বড় উৎস। তালেবান এখন কসটেপা সেচ খাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। আমু দরিয়া নদীকে কেন্দ্র করে এই সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হলে উজবেকিস্তান ও তুর্কেমিস্তানে পানিপ্রবাহ ১৫ শতাংশ কমে যাবে। এতে দুটি দেশেই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব পড়বে। ইরানের সঙ্গে তালেবানের পানিকেন্দ্রিক আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তেহরান পানি না দেওয়ায় তালেবানরা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীসহ সেনাদের প্রস্তুত করছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসের শুরুতে কাজাখস্তানে আফগানিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তানে খাদ্যশস্য ও গম রপ্তানির জন্য দুই দেশের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়। আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ খনিজের মজুত আছে। এর মধ্যে ক্রিটিকেল বিরল খনিজও রয়েছে। সে কারণে আফগানিস্তানের লিথিয়াম খনিতে চীন বিনিয়োগ করেছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের আমু দরিয়া নদীর বেসিনে তেলকূপ খননের জন্য চীনের কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। যদিও এসব প্রচেষ্টার মানে এই নয় যে, তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা থেকে এটি বলা যায় যে, ধীরে হলেও তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া অবধারিত। আর ওয়াশিংটনের তরফ থেকে যখন তালেবানের সঙ্গে কাজ করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন সেটি আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কাতারের দোহায় সম্প্রতি দুইপক্ষের উচ্চপর্যায়ে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানের জনগণের প্রতি তালেবানের আচরণ ও ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ওয়াশিংটন তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে তাদের এই সংলাপ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের নীতির দৃশ্যমান বদল। কাবুলে নতুন পর্যায়ে তালেবান শাসন ২ বছর পূর্ণ করল। তালেবান শাসকরা এই ২ বছরে তাদের নিপীড়ন জনগণের ওপর আরো শক্ত করে চাপিয়ে দিয়েছে। কাছের ও দূরের প্রতিবেশী দেশগুলোর পুরোনো ও নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনে তারা তেমন কিছুই করেনি। সুতরাং তালেবান সরকারের সঙ্গে আবার কাজ করার এই আপাত-ইচ্ছা প্রকাশ করা তাদের ভুল বার্তা দেবে। এতে আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আসবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। তালেবানের কৌশলগত পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে, তা হলো- তালেবানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যাবে, ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখুন্দের নিয়োগ ছিল অবশ্যম্ভাবী। তার নিয়োগকে সাবেক (১৯৯৬ থেকে ২০০১) তালেবান শাসনের ধারাবাহিকতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা তালেবানের সামনে দেশের ভেতরে গুরুতর কোনো বিরোধী শক্তি নেই। হয়তো সে কারণেই তারা বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিসর তৈরি করতে আগ্রহী হচ্ছে। গত ২ বছরে বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার সুবাদে তালেবান নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে, পরস্পর সংযুক্ত আজকের দুনিয়ায় নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের ধারণা অবাস্তব।

বিশেষ করে, মানবিক সংকটের মধ্যে বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে দেশ চালানো খুবই দুরূহ। তালেবান সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত অনমনীয় থাকার যে নীতি এত দিন অনুসরণ করে এসেছে, তা থেকে তাদের সরে এসে উদারনীতি সম্প্রসারণের দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। কবিরের নিয়োগ সে আভাসই দিচ্ছে। তালেবানের নতুন নীতিতে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। কবিরের নিয়োগের মধ্য দিয়ে তালেবান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মিশতে চায়। আন্তর্জাতিক নেতাদের এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। পশ্চিমাদের উচিত তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। একই সঙ্গে উন্নয়ন সহায়তার বিষয়টি ক্রমে পুনঃপ্রবর্তন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব যে প্রস্তুত আছে, তা আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে স্পষ্ট করা দরকার। গত কয়েক দশকের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট এবং এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার মতো একটি সম্ভাব্য সংঘাত প্রতিরোধ করতে এই ধরনের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত