মেধাবী তরুণদের আত্মহত্যা দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি

আরকে চৌধুরী

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি কক্ষে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন শেখ মঞ্জুরুল হক নামের এক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা তার পরিবারেরই নয়, দেশের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি। একজন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু এবং একজন প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী তরুণের মৃত্যু এক অর্থে বিবেচ্য নয়। তরুণরা জাতির ভবিষ্যৎ, বিশেষত যারা শিক্ষিত ও মেধাবান।

অত্যন্ত উদ্বেগজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমাগত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। চলতি বছর ১৭ মে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভির আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর তিন দিনের মাথায় একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরেক শিক্ষার্থী সামীয়ুল রহমান আত্মহত্যা করেন। একই তারিখে রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফী তাদের ঢাকার বাসায় আত্মহত্যা করেন। ইতোপূর্বে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়, গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আঁচল ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থার হিসাবে ২০২২ সালে ৬০০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়সহ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পর্যায়ের শিক্ষার্থীও রয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি শুধু অভিভাবকদের মধ্যেই নয়, বরং শিক্ষক, সমাজবেত্তা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এও লক্ষ্য করা যায়, লেখালেখি, কর্মশালা, সভা-সেমিনার এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা আত্মহত্যা নিরোধে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট ইত্যাদির পাশাপাশি নানাবিধ ব্যর্থতা, মাদকাশ্রয় এবং চরম হতাশা থেকে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা। দৈশিক ও সামাজিক বাস্তবতা তাদের আত্মহত্যা ছাড়াও নানা ধরনের বিপথগামিতা, উগ্রতা ও সন্ত্রাসমুখিতার দিকে ধাবিত করছে। কেউ যখন কারণে-অকারণে বঞ্চনা, ব্যর্থতার শিকার হয়, জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণায় উপনীত হয়, তখন আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয় এবং নিজের জীবন নিজেই হরণ করে। বঞ্চনা-ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার মানসিক শক্তি এবং জীবনের মূল্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে তার পক্ষে আত্মহত্যার মতো গর্হিত পথ বেছে নেওয়া সম্ভব হতে পারে না। উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের দেশেই কেবল নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতেও আত্মহননের প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। এটি দেশ বিশেষের সমস্যা যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। জাতীয়ভাবে তো অবশ্যই, আন্তর্জাতিকভাবেও এর মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। আমাদের দেশে এক সময় দারিদ্র্যের কারণে অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যেত। প্রেমে ব্যর্থতা এবং কোনো কিছুর অপ্রাপ্তিতেও অভিমানবশত কেউ কেউ আত্মহত্যা করত। এখন এসব কারণ ছাড়াও অন্যান্য কারণও যুক্ত হয়েছে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশেও যখন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে, তখন বলতে হবে, ‘সুখের অসুখ’ এর জন্য কম দায়ী নয়।

ধর্ম চর্চার অভাব এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় আত্মহত্যার প্রবণতা ও সংখ্যা বৃদ্ধির আসল কারণ। সব ধর্মেই আত্মহত্যাকে মহাপাপ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মের অনুশাসনের মান্যতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকলে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক প্রতিফলন ঘটলে কোনো দেশে বা সমাজেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে না। পরিতাপজনক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ৯২ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে, যাদের ধর্ম আত্মহননকে অমোচনীয় পাপ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, সে দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে।

যেহেতু আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক বৈকল্য বা সমস্যার সম্পর্ক আছে, সুতরাং মানসিক চিকিৎসার প্রসারও জরুরি। যথাযথ কাউন্সিলিং হতে পারে এর একটি কার্যকর চিকিৎসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, সেই মঞ্জুরুল হক নাকি মাদকে আসক্ত ছিলেন। প্রেমঘটিত ব্যাপার ছিল। তিনি দুই বছর পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছেন বলেও খবরে উল্লেখ আছে।

হঠাৎ করেই বেড়েছে আত্মহত্যা। শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সি এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সি মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা।

সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এর বেশিরভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরো বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধসমূহ ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায়প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরো বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে। কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না হলে বিষণ্ণতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়।

আত্মহত্যা মহাপাপ। আইন অনুযায়ী একটি অপরাধ। জগতের সব ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্রে আত্মহত্যার সমর্থনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে কেন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? আত্মহত্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগ এবং প্রয়াস রয়েছে, তথাপি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই। আত্মহত্যার পেছনের গল্প যদি তালাশ করি তাহলে স্বভাবতই যে চিত্রটি মানসপটে ভেসে আসে তা হলো- যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার মাঝে ফারাক, নেতিবাচক চিন্তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতায় হীনম্মন্যতা, আস্থাহীনতাসহ নানা উপাদান কিনা অনুঘটক হিসেবে রসদ জোগায়।

এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী? এ থেকে পরিত্রাণে মানসিক চিকিৎসা, ইতিবাচক মনোভাব, সহমর্মিতা, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো, বক্তব্য শেয়ার করার পরিবেশ তৈরি, আত্মসমালোচনা। আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। একই সঙ্গে সিনেমা-নাটক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলে তবেই আত্মহত্যা প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে এর প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, সবাইকে সচেতন করতে হবে।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।