ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশু শ্রমিকদের কান্না থামবে কবে

রায়হান আহমেদ তপাদার
শিশু শ্রমিকদের কান্না থামবে কবে

বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। বাংলাদেশে শিশু অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭৪ সালে পাস করা হয় শিশু আইন-১৯৭৪। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর একটি। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াসে প্রণয়ন করা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০, জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা-২০১০, জাতীয় শিশু নীতিমালা-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৫। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ সালে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান, শিশু আইন ও আন্তর্জাতিক সনদগুলোর আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিত করা হবে। আরো বলা হয়েছে শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের কথা, শিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা। কিন্তু এসব নীতি ও আইনের বাস্তব প্রয়োগ দৃশ্যমান হয় কোথায়? ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়নের পর আজ পর্যন্ত কোনো বিধিমালা আসেনি। ফলে আইন বাস্তবায়নে দেখা দিচ্ছে প্রতিবন্ধকতা এবং উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিশু নির্যাতন। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ প্রতি বছর আসে ও যায়। এবং বলা হয়-‘আজকের শিশু আনবে আলো, বিশ্বটাকে রাখবে ভালো’। যে দেশে শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে বেড়ে ওঠে, সে দেশের শিশুরা ভবিষ্যতের জন্য আলো নিয়ে আসবে কী করে, সেই প্রশ্ন মনকে বিচলিত করে। যে দেশে বছরের প্রথম ৯ মাসের মাথায় ৬০০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, সে দেশে তাদের শৈশব আর যা-ই হোক, আলোকিত হতে পারে না। ভয়ে মোড়ানো অন্ধকারাচ্ছন্ন শৈশবের পথ বেয়ে আলোকিত ভবিষ্যতের দেখা মেলে কি? উল্লেখ্য যে, মাত্র দুই বছরের মধ্যে দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার অঙ্গীকার আমাদের আছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের ৮ দশমিক ৭ নম্বরে সেটাই বলা হয়েছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংশ্লিষ্ট কনভেনশন ১৩৮ এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার-সংক্রান্ত কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে সরকার। এসব কনভেনশনে শিশুকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এসব প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার আলোকে শ্রম মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খেটে খাওয়া শিশুদের নিয়ে তাদের এক অন্তর্বর্তীকালীন জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। এই জরিপের নাম দেওয়া হয়েছে শিশুশ্রম জরিপ ২০২২। এর আগে ২০১৩ সালে একই শিরোনামে আগের জরিপটা করা হয়েছিল। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা গত ১০ বছরে না কমে বরং বেড়েছে। তবে কিছুটা হলেও কমেছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা। শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের তথ্য জানতেই জরিপটি পরিচালনা করা হয়। সারা দেশের ৩০ হাজার ৮১৪ খানা থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৫ থেকে শুরু করে ১৭ বছর বয়সিদের জরিপে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিল ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন।

বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত-২০১৮) অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। তবে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন হালকা কাজ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, দেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ৭০৯টি কারখানার মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, সেখানে মোট ৯ হাজার ১৯৪ জন শ্রমিকের মধ্যে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৮২০ জন শিশু।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই শিশুশ্রমিকদের অধিকাংশেরই বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। শ্রম আইন সেখানে কেবলই কিছু কাগজ। শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত বছর (২০২২) আরো পাঁচটি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, তবে সেগুলো নিয়ে কোনো নতুন গেজেট প্রকাশিত হয়নি। ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দূরারোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। বাংলাদেশের ঝালাই, সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অনেক দিন ধরে। বিবিএস তাদের জরিপে গেজেটের বাইরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোকে আমলে নেয়নি। নিলে হয়তো ফলাফলে আরো বাস্তব অবস্থার ছবি পাওয়া যেত। নানা ফোরামে শিশু গৃহকর্মীদের অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও আমলকারীরা বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চান না। এবারো জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। এবং চার দেওয়ালের ভেতরে যে শিশুশ্রম হয়, তাদের বের করে আনতে হবে। বাসাবাড়িতে অনেক বাচ্চা শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অথচ আমরা সবাই জানি, শিশুরাই দেশ ও জাতির কর্ণধার। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজকের শিশুরাই আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার সুমহান দায়িত্ব হাতে নেবে। এজন্য শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত