শিশুরা হয়ে উঠুক আলোকিত নাগরিক

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন ও সুরক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জাতীয় শিশু নীতি-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণয়ন করেছে। আর শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোররা হালকা কাজ করতে পারবে। আগে ১২ বছরের শিশুরা হালকা কাজের এ সুযোগ পেত। শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। অনুসন্ধান করে জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে যাদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। জরিপে বলা হয়েছে দেশের মধ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সব থেকে বেশি ঢাকা বিভাগে যা প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ এবং এর পরেই চট্টগ্রামে রয়েছে ৫.৮ শতাংশ শিশু শ্রমিক। দেশের মধ্যে শিশুশ্রম সব চেয়ে কম বরিশালে ১.৭ শতাংশ।

বিপজ্জনক কাজের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। ১৬ বছরের উপরে এবং ১৮ বছরের নিচে শ্রমিকদের কোনো প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি চালু অবস্থায় পরিষ্কারের জন্য, তেল প্রদানের জন্য বা তাকে সুবিন্যস্ত করার জন্য বা সেই যন্ত্রের চলমান অংশগুলোর মাঝে বা স্থির এবং চালু অংশের মাঝে কাজ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। কোনো কিশোর এমন কোনো যন্ত্রের কাজ করবে না যদি না সে উক্ত যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত বিপদ সম্পর্কে এবং এই ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত থাকে অথবা সেই যন্ত্রতে কাজ করার ব্যাপারে সে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে বা সেই যন্ত্র সংক্রান্ত অভিজ্ঞ এবং পুরোপুরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কাজ করে।

একজন কিশোর শ্রমিক কোনো কারখানা বা খনিক্ষেত্রে দিনে ৫ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৩৩ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে পারবে না এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দিনে ৭ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে পারবে না। কোনো কিশোর শ্রমিককে কোনো প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টার মধ্যে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কোনো কিশোর শ্রমিককে ভূগর্ভে বা পানির নিচে বা অন্য বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ২০১২ সালে সরকার শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ কাজের একটি তালিকা তৈরি করে, তবে এটি এখন অনুমোদিত হয়নি। এই তালিকাতে জাহাজ ভাঙ্গা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, নির্মাণকাজ এবং মোটরকারখানাতে কাজসহ ৩৬টি পেশার কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে, একটি নতুন আইন অনুমোদন করা হয়েছে (শিশু আইন ২০১৩) যা শুধু শিশুদের কাজের জন্য আইনগত বয়স স্থির করে না বরং যদি কর্মসংস্থানে শিশু শোষিত (একটি শিশুর জীবন এবং উপার্জনকে জব্দ করার মাধ্যমে) হয় তাহলে কঠোর শাস্তিও নির্ধারণ করে, যা হলো দুই বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়ই হয়ে থাকে। যদি কোনো ব্যক্তি বিশেষ লাভ ভোগের জন্য কোনো শিশুর কর্মসংস্থান করে বা অনৈতিক বিনোদনের জন্য কোনো শিশুকে ব্যবহার করে তবে তাকে সেই দোষের পোষক হিসেবে ধরা হবে। (শিশু আইন ২০১৩ এর ধারা ৮০, শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৩৯-৪২, সংশোধিত ২০১৩) শিশুশ্রমকে শিশুদের জীবনের একটি অমানবিক অধ্যায় বলা যায়। শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের স্বাভাবিক মেধার কোনো বিকাশ ঘটে না। ফলে শিশুরা অন্ধকারে থেকে যায়। নিম্নে শিশু শ্রমের নেতিবাচক প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো- শিশুশ্রম শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শিশুদের স্বাস্থ্য দুর্বল হলে তারা পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশু শ্রমিকদের অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে হয়। এতে তাদের জীবনে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। শিশুশ্রম দেশের স্বাক্ষরতার হারকে কমিয়ে দেয়। সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ে যায় না এবং ৫০ শতাংশ কখনো যায়নি। শিশুরা কাজ করার ফলে স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলে। এভাবে শিশুশ্রমের সঙ্গে শিশু শিক্ষার একটি বিপরীতমুখী অবস্থা সৃষ্টি হয়। শিশুশ্রম জাতীয় অর্থনৈতিতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। মালিক শ্রেণির লোকেরা শিশুদের কম মজুরীতে ব্যবহার করে। এর ফলে আয়ের সম বণ্টন হয় না। শিশু শ্রমিকরা বেশিরভাগ সময়ই অপরাধপ্রবণ মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠে। অনেক সময় তারা নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিশোধমূলক মনোভাবের দিকে ধাবিত হয়। আর এভাবেই শিশুশ্রম সমাজে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। পরিশেষে বলতে চাই- বাংলাদেশের শ্রমবাজারে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পুরো দেশ ও জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। যেহেতু শিশুরা আগামী দিনে দেশ ও জাতির হাল ধরবে তাই শিশুদের শ্রম থেকে মুক্তি দিয়ে শিক্ষায় আলোকিত করতে হবে। লেখক, প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।