ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেরিতে হলেও সর্বজনীন পেনশন ইতিবাচক উদ্যোগ

রায়হান আহমেদ তপাদার
দেরিতে হলেও সর্বজনীন পেনশন ইতিবাচক উদ্যোগ

সর্বজনীন পেনশনের মূল উদ্দেশ্য কর্মে অক্ষম বয়সে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান কিংবা জমাকৃত অর্থের ওপর সুদের শতাংশে লভ্যাংশ গুনে বাড়তি অর্থ ফেরত দেওয়া নয়; বরং উদ্দেশ্য অবসরকালে বাঁচার মতো ন্যূনতম অর্থ সুরক্ষা হিসেবে প্রদানের নিশ্চয়তা। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার দর্শন হচ্ছে ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করা, মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষের আর্থিক কষ্টের ঝুঁকি কমাতে অবসরের পরে পর্যাপ্ত আয় প্রতিস্থাপন করা। সরকার ঘোষিত পেনশন কর্মসূচি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১৮ বছর বয়সে যুক্ত ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক করতে লেগে যায় প্রায় ২৫ বছর, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩০ বছর। দেশে প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষিত যুবক স্থায়ীভাবে বেকার, যারা সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি করছেন। পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে বয়স যত বাড়বে, আনুপাতিক হারে কমতে থাকবে সুবিধাও, এটাই স্বাভাবিক। যে কেউ তার মোট জমাকৃত চাঁদার চেয়ে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩০ গুণ থেকে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৩১ গুণ টাকা পেনশন পাবেন। প্রশ্ন হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে পেনশন স্কিম যে পরিমাণ টাকা ফিরিয়ে দেবে বলে দাবি করছে, তার মূল্যমান তখন কত দাঁড়াবে? বর্তমানের চেয়ে তার ক্রয়ক্ষমতা কি কম হবে। বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে বিভিন্ন ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশেষে তা আলোর মুখ দেখতে চলেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি চালুর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর তুলনায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি থাকায় সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি শুরু করার এটাই প্রকৃত সময়। বিশ্বজুড়ে সাধারণত আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (ডিসি) এই চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এটির জন্য কোনো তহবিলও সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে অবশ্য বিমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশনব্যবস্থা চালু আছে। প্রতিবেশী ভারতে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয় পেনশনব্যবস্থা (এনপিএস) চালু করা হয়। শুরুতে সামরিক বিভাগ ছাড়া শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের জন্য চালু করা হয় এটি। গ্রাহক ও নিয়োগ কর্তা বা সরকার নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দেয় এনপিএসে, যা পরে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এতে ৬০ বছর বয়সে অবসরে যাওয়ার সময় ৬০ শতাংশ অর্থ নগদে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। বাকি ৪০ শতাংশ অর্থ পেনশন প্রদানের সুযোগ তৈরি করা হয়। ভারত ২০০৯ সালের ১ মে দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি সব নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা উন্মুক্ত করে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও পেনশন-সুবিধায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে একটি এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে আরেকটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয় ভারত। মাঝখানে ২০১৩ সালে সরকারি ব্যবস্থায় এনপিএস চালুর জন্য পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (পিএফআরডিএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবাদের জন্য সামাজিক পেনশনব্যবস্থাও চালু রয়েছে। চীনে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কর্মক্ষম। দেশটিতে তিন ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। শহরে কর্মরতদের জন্য আরবান পেনশন সিস্টেম (ইউপিএস), সরকারি ও আধা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সিভিল ও পাবলিক সার্ভিস পেনশন সিস্টেম (সিপিএসপিএস) এবং গ্রামে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিতদের জন্য রুরাল পেনশন সিস্টেম (আরপিএস) চালু রয়েছে দেশটিতে। ইউপিএস বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক-দুই ধরনেরই রয়েছে। এদিকে সরকারি ক্ষেত্রে ডিবি এবং গ্রাম ও শহুরেদের ক্ষেত্রে ডিসি পদ্ধতি চালু রয়েছে চীনে। ইউপিএসে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্মচারীর মূল বেতনের ২০ শতাংশ দেয়। আর কর্মচারী দেন তার মূল বেতনের ৮ শতাংশ। আরপিএস সম্পূর্ণ অংশগ্রহণমূলক। এতে সরকার ও ব্যক্তি উভয় অংশই নির্দিষ্ট হারে অর্থ জমা করে, যা থেকে মাসিক পেনশন দেওয়া হয়। সিপিএসপিএস সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয়। দেশটিতে রাষ্ট্রীয়, পেশাগত, ব্যক্তিগত ও আনফান্ডেড-এই চার ধরনের পেনশনব্যবস্থা চালু রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পেনশনেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতা, সম্পূরক পেনশন ও পেনশন ক্রেডিট নামক তিনটি অংশ। রাষ্ট্রীয় অবসর ভাতার আওতায় যাদের বার্ষিক আয় ৯ হাজার ৫০০ পাউন্ডের বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক চাঁদা দিতে হয় জাতীয় বিমায়। যাদের আয় রাষ্ট্র নির্ধারিত নিম্ন আয়সীমার নিচে তাদের দেওয়া হয় সম্পূরক পেনশন। এটা ঐচ্ছিক। আর পেনশন ক্রেডিট হচ্ছে, ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য, যাদের আয় কম। পেশাগত পেনশন হচ্ছে কর্মীর বেতন থেকে ৩ শতাংশ এবং সরকার বা কোম্পানি থেকে ৫ শতাংশ জমা হওয়ার পদ্ধতি। এটা বিনিয়োগ করে মুনাফার টাকাসহ পেনশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতিতে পেনশন দেওয়া হয় সব সামরিক, সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষকদের। আর ব্যক্তিগত পেনশন হচ্ছে বিমা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত একটি পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্রে ৯৪ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তায় এ দেশেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে করে জমা অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়। চাকরিভিত্তিক পেনশনের আওতায় কর্মী যা দেবেন, তার সমপরিমাণ দেবে সরকার বা কোম্পানি। এ ছাড়া আনফান্ডেড পদ্ধতি ও ব্যক্তিগত পেনশনব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের মতোই। অর্থ বিভাগের তৈরি করা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, উন্নত দেশ হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে বাজেট থেকে সবাইকে পেনশন দেওয়া হয়। জাপান, হংকং, কোরিয়া ও তাইওয়ানের পরিস্থিতিও উন্নত দেশগুলোর মতোই। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম পেনশন সংস্কার করছে। ফিলিপাইন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া অংশগ্রহণমূলক পেনশন পদ্ধতি শুরু করেছে। ইউরোপীয় মানদণ্ডে একটি অর্থবহ পেনশন-ব্যবস্থায় রেগুলেটর হিসেবে স্বাধীন সরকারি সংস্থা, সামাজিক সুরক্ষার ভর্তুকিদাতা হিসেবে দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়, বিনিয়োগ-সহায়ক হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তদারকিতে সরকারি-বেসরকারি স্বাধীন সংস্থার বহুমুখী সংযোগ দরকার। অংশীজন হিসেবে স্বাধীন সরকারি-বেসরকারি অডিট সংস্থা, সুনামধারী ও অভিজ্ঞ বিমা কোম্পানিগুলোও পেনশন তহবিল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে সবকিছুই করছে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং একটি মাত্র সরকারি ব্যাংক, যেটির বিরুদ্ধে মূলধন সংকট, আমানতে আস্থাহীনতা, ঋণ জালিয়াতি, ঋণখেলাপি ও ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে টাকা ছাপিয়ে বিশাল আকারের বাজেট ঘাটতি মেটানোসহ সার্বিকভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের মনে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন ও আমানত সংকট, মালিকানা বেহাত, অর্থ পাচার, ঋণ অবলোপন পুনঃতফসিল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ইত্যাদি বড় বড় জালিয়াতিতে আর্থিক খাতে নাগরিক আস্থা এখন তলানিতে। এসব সন্দেহের পরও সর্বজনীন পেনশন চালু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বরং বাংলাদেশ দেরি করেছে। সরকার নিজেই গ্যারান্টার বলে জমাকৃত অর্থ সত্যি সত্যি পাওয়া যাবে। প্রশ্ন ও বিতর্ক হওয়া দরকার কস্ট অব লিভিং, অর্থাৎ অবসরকালে আর্থিক পরিমাণের ন্যায্যতা এবং নিম্নবিত্তের স্কিমে সরকার ও চাকরিদাতার কন্ট্রিবিউশনের ওপর। অতিদরিদ্রদের জন্য সমতা স্কিমে চাঁদার পরিমাণ মাসে ১ হাজার টাকা, গ্রাহক প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেবেন। বাকি ৫০০ টাকা সরকার পরিশোধ করবে। বিপরীতে ১০ বছর পর ব্যক্তি মাসে ১ হাজার ৫৩০ টাকা করে পাবেন। দেড় হাজার টাকায় মাত্র ২ কেজি গরুর মাংস পাওয়া যায় না এখনই, ১০ বছর পরে এর ক্রয়ক্ষমতা কত হবে? এ দিয়ে ব্যক্তি চলতে পারবেন না, দারিদ্র্য বিমোচনও হবে না। ডলারের মুদ্রাস্ফীতি ঘটায় বাংলাদেশের দরিদ্র ও অতিদরিদ্রসীমা ভুল, ভারতের আদলে পোভার্টি লাইন পুনর্নিধারণ করা দরকার। সামাজিক ভাতাভোগীরা পেনশনের স্কিমে অযোগ্য, এটা অগ্রহণযোগ্য। অতিদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্নআয়ের মানুষসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ বা ৮৯ শতাংশ মানুষকে যেকোনো বয়সের কর্মহীন জীবনের সুরক্ষা দেওয়া আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত