ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জি-২০ সম্মেলন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা, সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
জি-২০ সম্মেলন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

নব্বইয়ের দশকে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল এশিয়ার অনেক দেশ। এ সংকট শেষে ১৯৯৯ সালে বিশ্বের বড় ২০টি দেশ একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলেন। তারা বুঝতে পেরেছিল, এমন সংকট কোনো একটি দেশের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আরো অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। জি-২০ গঠনের শুরুর বছরগুলোতে শুধু সদস্য দেশগুলোর অর্থ বিভাগের প্রধানরাই সম্মেলনে যোগ দিতেন। তবে ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সংকটের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতিবছর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে জোটের সদস্য দেশগুলোর নেতারা অংশ নেবেন। ২০০৯-এর ২৫ সেপ্টেম্বরে জি-২০-এর নেতারা ঘোষণা দেন যে, জি-৮ কে জি-২০ অদূর ভবিষ্যতে প্রতিস্থাপন করবে। কানাডার সাবেক অর্থমন্ত্রী পল মার্টিন প্রথম জি-২০ গঠনের প্রস্তাব করেন।

জি–-২০ জোটের বর্তমান সদস্য আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

প্রতিটি শীর্ষ সম্মেলনে জি-২০-এর সদস্য নয়, এমন দেশ অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনটিতে ভারত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল সিসি, নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে, মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ কুমার জুগনাউথ, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ টিনুবু, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং, স্পেনের প্রেসিডেন্ট পেদ্রো সানচেজ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও ওমানের উপ-প্রধানমন্ত্রী সাইয়্যেদ আসাদ বিন তারিক আল সাইদ। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এ সম্মেলনে তাদের মধ্যে আছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ, আন্তর্জাতিক সৌর জোটের মহাপরিচালক অজয় মাথুর, কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মহাপরিচালক অমিত প্রোথি, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মহাপরিচালক গিলবার্ট ফসুন হাউংবো, আর্থিক স্থিতিশীলতা বোর্ডের চেয়ার ক্ল্যাস নট, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃতালিনা জর্জিয়েভা, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার মহাসচিব ম্যাথিয়াস কোরম্যান, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইওয়ালা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানোস ঘেরব্রেয়ে।

বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮০ শতাংশই এই জোটের দখলে। আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের সঙ্গে জড়িত জি–-২০ দেশগুলো। ২০২৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো হলো বহুপক্ষীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো ঋণের ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক ঋণকাঠামোর সংস্কার, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে নীতিমালা তৈরি এবং খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব। ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এবারের জি-২০ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘ভাসুধাইভা কুতুমবাকাম’। সংস্কৃত এই শব্দ দুটির অর্থ ‘পুরো বিশ্ব,একটি পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবসহ সব জীবনের মূল্য, পৃথিবী ও বিস্তৃত গ্রহে তাদের আন্তঃসম্পর্ককে কেন্দ্র করে এজেন্ডটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

দুটি উদ্দেশ্যে জোটটি কাজ করে থাকে। একটি অর্থনৈতিক আর অন্যটি শীর্ষ সম্মেলনের আগে কূটনৈতিকদের প্রস্তুতিমূলক কাজ। অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরগণ দিকগুলোর নেতৃত্বে থাকেন। অর্থনৈতিক দিকগুলো ঠিক হওয়ার পর কূটনীতিকরা বিভিন্ন নীতি ঠিক করেন। বিশ্বব্যাপী যে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। সেই সংকট নিরসনে অবশ্যই সবগুলোকে আন্তরিক হয়ে সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। যেখানে জি-২০ জোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

বিশ্বের শিল্পোন্নত ২০টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত জি-২০ হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোট। বৈশ্বিক অর্থনীতির মূল বিষয়গুলোর ওপর আলোচনার জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যেই এই জোট গঠিত হয়।

আয়োজক দেশ ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশকেই ‘গেস্ট কান্ট্রি’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেশী বন্ধু দেশের কাছ থেকে পাওয়া এ আমন্ত্রণ অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক সম্মানের। এটা শেখ হাসিনার সরকারের একটি কূটনৈতিক সাফল্য বটে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক মজবুত হয়েছে। মানুষের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। জি-২০ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার এক অনন্য সুযোগ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জিডিপি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী ও দৃঢ় নেতৃত্বে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, ২০৩৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২৪তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো ২০৩১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট উন্নত দেশে পরিণত হওয়া। আশা করা যায়, অচিরেই বাংলাদেশ জি-২০ জোটে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।

বিশ্ব এক শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ানক মহামারির কুপ্রভাব, যুদ্ধ, নানা দ্বন্দ্ব, বিবাদ এবং অনেক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা এই সম্মেলনে থাকবেন, হবেন না। থাকবে তাদের প্রতিনিধিরা। দুটি বৃহৎ শক্তির প্রেসিডেন্ট না আসায় এ সম্মেলন নিয়ে কূটনৈতিক মহলে বিভিন্ন আলোচনা শুরু হয়েছে ।

এই জি-২০ সম্মেলনের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলন কূটনৈতিক একটি তাৎপর্যবাহী ঘটনা হয়ে উঠছে। আজ গোটা পৃথিবীতে অশান্তি, আর্থিক দুরবস্থা, কর্মহীনতা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি সময়ে ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।

জি-২০ সম্মেলন ও ব্রিকস সম্মেলন দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বহন করে বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা। চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ারযুদ্ধ। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন। বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হতে পারে এই সম্মেলনে পৃথক পৃথকভাবে। হিমালয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের কৌশলগত প্রতিযোগিতা রয়েছে।

সব দেশের সীমান্ত সমস্যাগুলো ঐতিহাসিক বিরোধ, জাতীয় গর্ব এবং কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সরকারের সাফল্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। এই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবের বিষয়। জি-২০ সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বহুমাত্রিক কূটনীতিকে কতটা প্রভাবিত করে, সেটাই দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত