প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে জীবন বাঁচায় এবং প্রাত্যহিক জীবনে নানা সংকট থেকে রক্ষা করে, সে বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়েই এই ভাবনার উদ্ভব। আমরা জানি না কখন আমাদের নিজেদের বা আমাদের ভালোবাসার লোকদের বা আমাদের চারপাশের লোকদের ওপর আঘাত আসতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসা হলো সামান্য বা গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাতজনিত যেকোনো ব্যক্তিকে জীবনরক্ষা করতে, অবস্থার অবনতি থেকে বাঁচতে বা পুনরুদ্ধারের জন্য যত্নসহকারে দেয়া প্রথম বা তাৎক্ষণিক সহায়তা। এটির মধ্যে পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার আগে গুরুতর অবস্থায় প্রাথমিক হস্তক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন- ছোটোখাটো অবস্থার চিকিৎসা দেয়া, প্লাস্টার বা ব্যান্ডেজ করা, একজন আহত রোগীর রক্তপাত বন্ধ করার উপায় প্রয়োগ করে জীবন বাঁচানো, পাশাপাশি পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার আগে কার্ডিওপলমোনারি পুনর্বাসন (সিপিআর) সম্পাদন করা। প্রাথমিক চিকিৎসা সাধারণত এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেউ করে থাকেন। সুতরাং, গুরুতর পরিস্থিতিতে যত্ন নেয়ার জন্য, খারাপ থেকে আরো খারাপ হওয়া বা চিকিৎসা সহায়তা না আসা-অবধি সুস্থ্ রাখার জন্য প্রত্যেকের কিছুটা প্রাথমিক জ্ঞান থাকা ভালো।
আহত ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা করে আহত ব্যক্তির অবস্থা উন্নত করা ও সংক্রমণ এড়ানোর চেষ্টা করা এবং বড় কোনো দুর্ঘটনায় বা জরুরি মুহূর্তে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া
দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, প্রাথমিক চিকিৎসা করে আহত ব্যক্তির অবস্থা উন্নত করা এবং সংক্রমণ এড়ানোর চেষ্টা করা। জীবন বাঁচাতে প্রাথমিক চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞান প্রয়োজন।
তৃতীয় লক্ষ্যটি হলো, বড় কোনো দুর্ঘটনায় বা জরুরি মুহূর্তে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত কাজ করার দক্ষতা জীবন বাঁচাতে এবং আঘাতের প্রভাব কমাতে সহায়তা করতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসার ইতিহাস : ১৬০ বছরেরও বেশি পুরোনো। সলফ্রিনো (১৮৫৯) এর যুদ্ধে হেনরি ডুনান্ট নামে এক ব্যবসায়ী সেখানে ছিলেন, সেখানকার হত্যালীলার সাক্ষী হন। তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মেমোয়ার্স অফ সলফ্রিনো, নামে একটি বই লেখেন, সেই বইতে ডুনান্টের ধারণার ভিত্তিতে আইসিআরসি নামক একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে সৈন্যদের যত্ন নেয়ার জন্য। পরে, তিনি রেড ক্রসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হন। উনিশ শতকে তার আবিষ্কার থেকে আজ-অবধি মানুষের দুর্দশা বর্তমান। যুদ্ধের আঘাত থেকে প্রতিদিনের রাস্তায় এবং পারিবারিক দুর্ঘটনা পর্যন্ত প্রাথমিক চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন গুরুত্বপূর্ণ : সুরক্ষা বাড়ায় : প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণের ভিত্তি হলো ‘প্রতিরোধ’। ‘দুঃখিত’ হওয়ার চেয়ে নিরাপদ থাকা সব সময় ভালো।
প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞানটি মানুষের মধ্যে সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের বোধকে উৎসাহ দেয়, তারা আশপাশে যে পরিবেশে বাস করে, তাদের আরো সচেতন ও নিরাপদ হতে উৎসাহ দেয়। ব্যথা উপশম করতে সহায়তা করে : কিছু আঘাতের জন্য আইস প্যাক লাগানো বা দ্রুত ঘষার মতো খুব সাধারণ সমাধান প্রয়োজন। কিছু কিছু সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ ক্ষেত্রে, প্রাথমিক চিকিৎসা কোর্সে প্রশিক্ষিত একজনের সহায়তাই যথেষ্ঠ। প্রাথমিক চিকিৎসার সহজ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে ব্যথা কমাতে সহায়তা করা যায় এবং কমপক্ষে অস্থায়ীভাবে ব্যথা উপশম করা যেতে পারে।
জীবন বাঁচাতে সহায়তা করে : প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োগে আশপাশে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এবং দুর্ঘটনা কবলিত মানুষের জীবন বাঁচানো যেতে পারে। দুর্ঘটনা-কবলিত অবস্থায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ট্রমাজনিত পরিস্থিতিতে বেশি উপকার করতে পারেন। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে বাধা দেয় : প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি জানেন কীভাবে পরিস্থিতিকে খারাপ থেকে আরো খারাপ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। পেশাগত সহায়তা না আসা পর্যন্ত তারা অস্থায়ী চিকিৎসা সরবরাহ করবে, যা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অবস্থার অবনতি থেকে রক্ষা করবে। আর যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তা কখনো কখনো সুফল বয়ে আনে বা কারও জীবন রক্ষা করতে সহায়তা করে। তবে প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে কারো ভালো জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ থাকলে সে দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কোনো অসুস্থতা বা আঘাতের পর করণীয় ঠিক করতে পারে, যা জীবন রক্ষা করতে পারে। আর বাড়িতে একটি ফার্স্ট এইড বক্স থাকলে তা কাজেই লাগবে। ফার্স্ট এইড বক্স হলো একটি বহনযোগ্য বক্স। এতে অনেক কিছুই থাকতে পারে। যেগুলো নিয়ে প্রাথমিকভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনার মোকাবিলা করা যাবে। যাতে একজন মানুষ কোনোভাবে আহত বা হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তাকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যায়। কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, এখন কী করতে হবে রোগীর জন্য।
আবার কিছু থাকে, যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে অবস্থা সামাল দিয়ে কিছু সময় পাওয়া যায়, যেটা ব্যবহার করে দুর্ঘটনায় পড়া মানুষকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পরিধি বিস্তার : রান্নাঘরের আগুনের আঁচে হাত পুড়ে ফোসকা পড়া বা ছুরিতে হাত কেটে যাওয়া থেকে অনেক বড় সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবি, বন্যা থেকে সুনামি, যেকোনো সংকটপূর্ণ মুহূর্তে, যেকোনো অসুস্থতায় প্রথম ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপই প্রাথমিক চিকিৎসার অন্তর্গত।
যেকোনো দুর্ঘটনায় আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণে পদক্ষেপটি বহুলাংশে কার্যকর হতে পারে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি জীবন রক্ষা করতে সহায়তা করবে। এমনকি আমরা ট্রাভেল বা ভ্রমণ করার সময়ও একটি ফার্স্ট এইড বক্স সঙ্গে রাখতে পারি। এতে অনেক কিছুই থাকতে পারে। যেমন- গজ, ব্যান্ডেজ, সিজার, ডেটল, স্যাভলনের মতো অ্যান্টিসেপ্টিক, কিছু জরুরি ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন, ডায়াবেটিক রোগীর জন্য চিনি ইত্যাদি। এগুলো দিয়ে প্রাথমিকভাবে ছোটখাটো দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা যাবে, যাতে একজন মানুষ কোনোভাবে আহত বা হঠাৎ করে অসুস্থ হলে তাকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যায়। কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, যেমন- ব্লাডপ্রেশার মাপার মেশিন, ডায়াবেটিস রোগীর সুগার চেক করার জন্য গ্লুকোমিটার। ফার্স্ট এইড কিটের সম্ভাব্য জিনিসপত্রগুলো হলো তথ্য লিফলেট, মাঝারি ও বড় স্টেরাইল ড্রেসিংস, ব্যান্ডেজগুলো- গজ রোলার ব্যান্ডেজ/ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ/আঠালো ব্যান্ডেজ/ত্রিভুজাকার ব্যান্ডেজ, টর্নিকোয়েট, সুরক্ষা পিন, জীবাণুমুক্ত ভেজা ওয়াইপ, মাইক্রোপারাস টেপ, নাইট্রাইল গ্লাভস, ফেসশিল্ড, ফয়েল কম্বল, পোড়া পোশাক, পোশাকের কাঁচি, কনফার্মিং ব্যান্ডেজ, ফিঙ্গার ড্রেসিং, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, কাঁচি, ট্যুইজার, সরঞ্জামগুলো স্যানিটাইজিংয়ের জন্য অ্যালকোহল প্যাড, কয়েকটি জরুরি ওষুধ ইত্যাদি।
এসব সরঞ্জামের সাহায্যে প্রাথমিকভাবে অবস্থা সামাল দিয়ে কিছু সময় পাওয়া যায়, যাতে দুর্ঘটনায় পড়া মানুষকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান,
জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি