শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা

প্রতিরোধে বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনতা

প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। কে, কখন, কোন কারণে আত্মহত্যা করবে, সেটা অনুধাবন করার সুযোগ কম। আধুনিক যুগে এই ব্যস্ত সময়ে অভিভাবকদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার সুযোগ পায়। অথচ তাদের গতিবিধির ওপর অভিভাবকের অবশ্যই নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় শিক্ষার্থী আত্মহত্যার একটি ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে বলা হয়েছে- চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮ মাসে ৩৬১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থী ১৬৯, কলেজশিক্ষার্থী ৯৬, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৩০ জন। এ সময় ১৪৭ জন পুরুষ শিক্ষার্থী ও ২১৪ জন নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আগের বছরের একই সময়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৩৬৪ জন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ রংপুরে বিভাগে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১০ শতাংশ এবং রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং বরিশালে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এব সিলেটে আত্মহত্যা করে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থীদের। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে। অন্যদিকে, ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। নারী শিক্ষার্থীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখা যায়, ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী অভিমান করে, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, ৫ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে এবং পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশই ছিল স্কুলগামী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১১২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ছিল ৫৭ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সি শিক্ষার্থী। ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল এই বয়সি। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১৫৯ জন। অন্যদিকে, পুরুষ শিক্ষার্থী ৮৪ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।

আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫৭ জন এবং সমসংখ্যক পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়া আত্মহত্যার পেছনে আরো বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে প্রেমঘটিত, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অ্যাকাডেমিক চাপ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক সমস্যা। প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অ্যাকাডেমিক চাপের কারণে। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার কারণে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কম থাকার কথা থাকলেও, সেখানেও দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গত আট মাসে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছে। তাদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ছিল। আর পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। আত্মহত্যাকারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের পেছনে দায়ী ছিল অভিমান। রোমান্টিক সম্পর্কের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে যৌন নির্যাতন দায়ী। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো, শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো, পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সহানুভূতি এবং সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবার-অভিভাবকদের আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা। এছাড়া বাবা মা এবং সন্তানের মাঝে মানসিক দূরত্ব কমাতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি প্রতি ৩ মাস অন্তর সব শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা। তবে যাই হোক না কেন, এই সামাজিক ব্যাধি যে কোনো মূল্যে দূর করতে হবে।