স্কুলে পরীক্ষাবিহীন শিক্ষাক্রম

ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবার কাছেই দুর্বোধ্য

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার্থীরা পড়বে, মুখস্থ করবে ও পরীক্ষা দেবে। উত্তরপত্রে যা লিখবে, তা দিয়েই মূল্যায়ন। তা দিয়েই পরীক্ষার ফলাফল অর্জন করে সার্টিফিকেট পাবে। এটাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের চিত্র। তবে দেশে নতুন এক শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে, যেখানে পরীক্ষা থাকবে না। তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে, কেন শিখবে, তাদের এই শিক্ষা ভবিষ্যতে কোন কাজে লাগবে- তা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরাও জানে না। তাহলে জানে কারা, এ প্রশ্ন না জানাদের। পরীক্ষা ছাড়া হাতের কাজের ওপর মূল্যায়ন। এতো এক তাজ্বব ব্যাপার। আমাদের সন্তানরা লেখপড়ার মূল্যবান সময় ব্যয় করে খেলার সামগ্রী বানিয়ে, আলু ভর্তা বানানো ও নুডুলস রান্না করা শিখতে। এসবই করে দেন বাসার অভিভাবক আর মূল্যায়নের স্বীকৃতি পায় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাক্রম পুরোপুরি পাল্টে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নানা রকম কাজ করবে, বুঝবে, তারপর শিখবে। তাদের এসব কার্যক্রম দেখে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। থাকবে না কোনো পরীক্ষা। তবে এই পরীক্ষা না থাকা নিয়েই চরম ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। ‘পরীক্ষাবিহীন’ পড়াশোনায় কোনো অভিভাবকই যেন আস্থা রাখতে পারছেন না। এমনকি শিক্ষকরাও এ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। বাসায় বসে কখনো ফুল, কখনো ফল কখনো বা পশু-পাখি তৈরি করে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। সেটাই নাকি তাদের শিক্ষা। আর এই শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থী কি করবে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর হয়তো জানতে পারে। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ অভিভাবক এমন তাত্ত্বিক জ্ঞান ধারণ করে না। তারা জানে, সন্তান স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে পাস করবে। সার্টিফিকেট অর্জন করবে।

ভবিষ্যৎ জীবনে আয়-রুজি করে সংসারের হাল ধরবে। কাগজের বল কিংবা পাখি বানিয়ে কিংবা আলু ভর্তা আর নুডুলস রান্না করে স্কুলে নিয়ে পিকনিক করে খাওয়া তাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমাদের দেশের বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা খেচুরি রান্না শেখার জন্য বিদেশে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করেন সরকারি কোষাগারের ডলার খরচ করে। আবার মশার ওষুধ কীভাবে দিতে হয়, তা শেখার জন্য বিদেশ যাওয়ার জন্যও তারা বায়না ধরেন। যে দেশে ডেঙ্গু জ্বর নেই, সেই দেশে ডেঙ্গু মশা নিধনের শিক্ষা সরকারি ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা নেবেন নাকি- যারা নালা-নর্দমায় ওষুধ ছিটায় তারা নেবে। সেটাও বোধগম্য নয়। চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা চলছে নতুন শিক্ষাক্রমে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে, বাসায় আসছে। অথচ লেখাপড়া করছে না। হোমওয়ার্ক, প্রাইভেট শিক্ষক চাইছে না। শিক্ষার্থীরা স্কুলে যা শিখছে, বাড়িতে এসে যা করছে তা কোনো ‘পড়াশোনা নয়’ বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। শিক্ষকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের কারিকুলাম ও পাঠ্যবই সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে সাজানো। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী- শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দেওয়ার কোনো সুযোগই থাকছে না। স্কুলের কাজ স্কুলেই শেষ হচ্ছে। বাসায় গিয়ে পড়ার বা বাড়ির কাজ করার প্রয়োজন নেই। অভিভাবকদের কাছে এই অভিনব পদ্ধতি বোধগম্য নয়।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা অভিভাবক ও শিক্ষকের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের কাঁধ থেকে পরীক্ষার বোঝা নামিয়ে হাতে-কলমে শেখানোর প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতেই নতুন এ শিক্ষাক্রম। শিক্ষার্থীরা এ পদ্ধতিতে পড়াশোনা উপভোগ করছে। এখন অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। প্রশিক্ষণের ঘাটতি দূর হলে শিক্ষকদেরও ‘সংশয়’ দূর হয়ে যাবে। এই রাজধানী শহরে মুরগির ঘোপের মতো বাসায় আবার খাঁচায় মুরগি পালনের জায়গা কোথায়! মুরগিকে খাওয়ানো, পরিচর্যা ও মুরগির আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজটি কি শিক্ষার্থীকে দিয়ে করানো সম্ভব। সেটাও ভাবতে হবে। আমাদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানকে বা-মাকে ভাত খাইয়ে দিতে হয়, আর সে খাওয়াবে মুরগিকে। মুরগি পালনের মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকরা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ওই শিক্ষক ছাত্র জীবনে কোনো দিন মুরগি লালন-পালন করেছেন কি না। সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকা অভিভাবকরা এই শিক্ষণ পদ্ধতি বুঝতে পারছেন না। অভিভাবকরা ‘সচেতন নন’ পাল্টা অভিযোগ করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পুরো শিক্ষা প্রক্রিয়াটাই হাতে-কলমে শেখানো। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে এখনো প্রশিক্ষণ পাননি অধিকাংশ শিক্ষক। যারা এক দফায় প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাদের অনেকেই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়ানোর ক্ষেত্রে অতটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। ফলে সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষকরাও। প্রতিনিয়ত অভিভাবকের প্রশ্নে জর্জরিত হলেও দিতে পারছেন না সদুত্তর। শুধু মফস্বল নয়, রাজধানীর নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরও একই দশা। নতুন শিক্ষাক্রমে ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন করবে শিক্ষকরা। বাকি ৬০ শতাংশ মূল্যায়নের দায়িত্ব থাকবে শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের ওপর।