শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর দায়িত্ব

ড. কেএম আতিকুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কয়েকজন মিলিটারি জেনারেল আসলেন সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলের অফিসে সাক্ষাৎ করতে- ম্যাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের চেয়ে ঢের বেশি। যদি আমাদের বেতন কাঠামো তাদের সমান করতেন, আমাদের মর্যাদা একটু বাড়ত। এঙ্গেলা মার্কেল, ‘আপনারা কী আপনাদের শিক্ষকদের সমান হতে চান?’ সঙ্গে সঙ্গে জেনারেলরা মাথা নিচু করে সভা শেষ করে চলে গেলেন। প্রতি বছর ব্রিটিশ রানি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে একটি নির্দিষ্ট দিনে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাৎ দিবসে প্রথম ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করেন শিক্ষক, তারপর অন্যান্য শ্রেণি-পেশা (যেমন- প্রধানমন্ত্রী, আমলা-আমত্য প্রভৃতি)। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম বলতেন, ‘শিক্ষক হচ্ছে আধুনিকতা ও উন্নয়নের রূপকার।’ ওকে, মানলাম, শিক্ষকতা হলো ক্রিম পেশা। কিন্তু কীভাবে? কি তার অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর মগজ ও পদতলকে কতটা মসৃণ করতে পারল, তার ওপরই নির্ভর করে এর মাহাত্ম্য। যেমন- একজন ব্যাংকার চেক ইস্যু করেন, এটা তার রুটিন কাজ; প্রশাসক ফাইল ইস্যু করেন, যা কেবলই তার সরকারি কর্তৃক তৈরিকৃত কিছু দলিল। তাকে কিছু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত কাজও করতে হয়, যা সমষ্টিগত প্রচেষ্টার একটি ফসল। কিন্তু একজন শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে, সেমিনারে, সম্মেলনে, প্রতিক্ষণে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়। সৃষ্টি না করেও ক্লাস শেষ করা যায়, তবে সেটা কেবলই রুটি-রুজির চাকরিতে রূপান্তরিত হয়। এমন অবস্থা একজন শিক্ষককে মানসিকভাবে হত্যা করতে থাকে। তখন তার জন্য নেতিবাচক কোনো পন্থা অবলম্বন করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। শ্রেণিকক্ষ তখন একজন শিক্ষকের জন্য নিরানন্দ এবং বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সৃষ্টিশীল, সৎ ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের জন্য শ্রেণিকক্ষ আনন্দ ভোগের উৎসে পরিণত হয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সব কাজ তখন ‘আনন্দ খেলা’র মতো গণ্য হয়। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীরা মনের অজান্তে পিচ্ছিল কাঁচা রাস্তা হতে পাকা রাস্তা ধরে চলতে শেখে, যা একসময় তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। শিক্ষকের সন্তানকে দেখাশোনার জন্য অনেক আত্মীয়-পরিজন থাকে। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থী আছে, যাদের দেখাশোনা করার জন্য শিক্ষক ছাড়া আর কেউে নেই। স্বল্প শিক্ষিত (কিন্তু বিদ্যুৎসাহী) পিতা-মাতা মনে করেন, আমার ছেলেমেয়েকে ভালো শিক্ষকের কাছে পাঠিয়েছি, সে বড় মানুষ হয়েই আসবে। ওই শিক্ষার্থীদের মানুষ করার প্রায় সব দায়িত্ব তখন শিক্ষকের ওপর বর্তায়। শিক্ষক তখন শিক্ষার্থীর মুখ দেখামাত্রই তার সন্তানের দুঃখের কথা ভুলে যেতে পারে। এমতাবস্থায় প্রকৃতগতভাবে সন্তানের শিক্ষকরাও দয়াবান শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। শিক্ষকের সন্তান তখন ‘প্রকৃতির অদৃশ্য শক্তিতে’ বলীয়ান হয়ে ওঠে। এভাবে আমাদের সমাজকল্যাণকর জনপদে পরিণত হতে থাকে। দুর্বল ও পশ্চাৎপদ কোনো শিক্ষার্থীকে শুধু নাম ধরে ডাকার কারণেই সে আলোময় পথ খুঁজে পাওয়ার অনুপ্রেরণা পেতে পারে। অনেক সময় কোনো শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থীর ‘ভালো ভবিষ্যৎ’ গড়ার জন্যই এই শাস্তি। শাস্তির সংখ্যা ও পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে, যদি শিক্ষার্থীর পরিবারে আচরণ শিক্ষার যথাযথ চর্চা না থাকে। মা-বাবার আচরণও যদি দীর্ঘ সময় ধরে নেতিবাচকায় পরিপূর্ণ থাকে, তার সন্তানও শিক্ষালয়ে এসে ভালো আচরণ করতে সক্ষম হয় না। শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি কোনোক্রমে অহংকার এসে যায়, তার আচরণও নেতিবাচক হতে বাধ্য। আদর ও শাস্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পড়ালেখার জন্য যতটা হবে, আচরণের পরিবর্তনের জন্য হবে তার দ্বিগুণ। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর আচরণগত পরিবর্তন করাই শিক্ষকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘সরি’ বলার মনোভাব তৈরি করতে পারলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হৃদযোগ হতে পারে সহজে। আর শিক্ষার্থীরাও তখন সৎ হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে, কারণ তার শিক্ষক ভুল বা অন্যায়ের জন্য যদি সরি বলতে পারে, তখন তাদের নিকট এটা ভালো মানুষ হওয়ার টনিক হিসেবে কাজ করে। আমার স্যার যেহেতু ভালো মানুষ, অতএব শিক্ষার্থী মনে করে আমাকে ভালো হতে হবে।

‘সরি’ বলা শিক্ষকের যে কোনো পরামর্শ, উপদেশই তখন তারা মনের অজান্তে মানতে বাধ্য হয়। আলটিমেটলি ওই শিক্ষার্থীরা ১/২ বছরের শিক্ষা, দক্ষতা ও সততার পথে চলতে চলতে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ‘ধন্যবাদ’ শ্রেণিকক্ষের জন্য আরো একটি টনিক শব্দ, যা কাজ করে বিদ্যুতের মতো। শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ধন্যবাদ’ শব্দটা বড় একটি পুরস্কার বা স্বীকৃতি, যা তাকে দ্বিগুণ শক্তিতে পড়ালেখা করতে, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

একজন শিক্ষার্থী যখন ভালো শিক্ষকের নিকট হতে ধন্যবাদ, গুড অথবা গ্রেট শব্দগুলো অর্জন করে, তখন নিশ্চিতভাবে সে তার ক্লাসমেটদের নিকট ‘হিরো বা হিরোইন’ বনে যায়। তার এই ‘হিরোইজম’ ধরে রাখার জন্য সে নিয়মিত পড়ালেখা, পরিশ্রম করতে থাকে। অন্যরাও স্যারের স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ‘ধন্যবাদ বা কমপ্লিমেন্ট’ অর্জন প্রতিযোগিতা শ্রেণিকক্ষে রীতিমতো কনফারেন্স রুমে পরিণত করে। ফলে তা জ্ঞান বা দর্শন আদান-প্রদানের মন্দিরে পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের শ্রেণিকক্ষে ‘সরি বা ধন্যবাদ’ চর্চার আকাল লক্ষ্য করা যায়। আমাদের শিক্ষকরা হয়তো বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিতর্ক, আলোচনা-পর্যালোচনা, প্রশ্নোত্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ততটা ইন্টাররেক্টিভ হতে পারেন না। ফলে ‘সরি বা ধন্যবাদ’ বলার সঠিক ক্ষেত্র তৈরি হয় না। শিক্ষকদের গতানুগতিক ও গৎবাধা বক্তব্য প্রদান করার ফলে কোথায় ‘সরি বা ধন্যবাদ’ বলতে হবে, তা শিক্ষক হাতড়িয়ে পায় না। সুতরাং ‘সরি বা ধন্যবাদ’ বলার জন্য প্রশ্নোত্তর বা বির্তক সৃষ্টি করতে হবে। প্রশ্নোত্তর পর্বে আসবে ‘ধন্যবাদ’ এবং বিতর্কে আসবে ‘সরি’ বলার পরিবেশ।

‘সরি বা ধন্যবাদ’ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষকের উচ্চ ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, যা শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষক একজন অনুসরণীয় মডেলে পরিণত হবে। কিছু পরিবার হতে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যতিক্রম কিছু পন্থা অবলম্বন করা শিক্ষকের বিশেষ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিছু কিছু পরিবারের ছেলেমেয়েদের কৌশলে স্বীকৃতি, প্রশংসা বা বিশেষ নজর দিলে তারা খুবই আশান্বিত হবে। হীনমন্যতা ভুলে গিয়ে তারা নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করবে। এমন পন্থা তাদের জন্য সফলতার শিখর হতে পারে। তার অন্তরে ক্ষুধা, বঞ্চনা, লাঞ্চনা কারণে বড় হওয়ার যে কষ্টের আগুন তার ভেতরে জ্বলছে, সেটা নিমিষেই তার মন থেকে দূরীভূত হয়ে যায়। এখন শিক্ষকতা পেশাটাকে যেহেতু সবাই সহজ মনে করে এবং জবাবদিহিতার যেহেতু সংকট রয়েছে, তখন বুঝতে হবে, জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে সাচিবিক ডেস্কে অথবা মগজহীন প্রভাবশালী মানুষের টেবিলে। সুতরাং, শুধু পরীক্ষা কক্ষভিত্তিক শিক্ষা নয়, ডেস্কভিত্তিক সিদ্ধান্তে জাতি গঠন নয়, শ্রেণিকক্ষ ও আদর্শ পরিবারভিত্তিক শিক্ষা ও সমাজ গড়ে উঠুক, এটাই আমাদের কামনা। একজন ভালো শিক্ষকের মুখ হতে যদি কোনো স্বীকৃতি, প্রশংসাসূচক শব্দ শুনে, তখন সে মনে করে তার মধ্যে কিছু আছে, সে পারবে। সে জীবনকে তখন নতুনভাবে গড়ে তোলার সংগ্রামে নেমে পড়ে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ওই ধরনের পরিবার হতে আসছে। দেশের লিডিং পজিশনগুলোও পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারই দখল করছে। হ্যাঁ, ওই সন্তানগুলো কাউকে না কাউকে আইডল মানে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে শিক্ষকই তার সেই আইডল। শিক্ষার্থীর হৃদয়ে দোলা দিয়ে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষকে দেশ গড়ার একটি প্ল্যাটফর্মে পরিণত করতে পারে। অবশ্য দেশগড়ার যে দুটি সংগঠন মৌলিক অবস্থানে আছে, তা হলো পরিবার ও শ্রেণিকক্ষ।

প্রস্তুতিবিহীন ও নোট খাতাবিহীন শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ, শিক্ষকের জন্য যেমন অস্বস্তিকর শিক্ষার্থীদের যেমন তেমন বিরক্তিকর। গতানুগতিক স্টাইলে মূর্তির মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকের ডেলিভারি শিক্ষার্থীর বিরক্তিসৃষ্টি ব্যতিরেকে অন্য কিছু দেয় না। প্রতিক্ষণে দমকা হাওয়া সৃষ্টি করে ধানক্ষেতের দোলা সৃষ্টি করায় শিক্ষকের কাজ। এতে শিক্ষার্থীর মগজে একটি ঝড় বয়ে যাবে, যা তাকে চিন্তাশীল ও সৃষ্টিশীল করে তুলবে। নিকট পরিবেশ হতে উদাহরণ দিয়ে শিক্ষক প্রতিটি টার্ম, আইডিয়া ও কনসেপ্ট ব্যাখ্যা করলে শিক্ষার্থী তা সহজে বুঝতে সক্ষম হয়। অবশ্য একজন শিক্ষককে ওই প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে চিন্তা, স্টাডি ও প্ল্যান করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলে ভালো হয়। আর শিক্ষক যদি এগুলো না করেন এবং সর্বদা ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটান তখন তার ইনোভেশন দক্ষতাগুলো মরে যেতে থাকে। শিক্ষক যখন একজন মডেলের মতো অভিনয়, আনন্দ ও রস দিতে সক্ষম হয়, শিক্ষার্থী তখন শ্রেণিকক্ষে আনন্দ পায় ও শিক্ষা গ্রহণে অধিকতর মনোযোগী হয়। এমতাবস্থায় সে বড় হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতে থাকে। শিক্ষার্থী প্রশ্ন করলে ধন্যবাদ, যেকোনো উত্তর দিলে ‘হ্যাঁ’ সূচক ফিডব্যাক দিলে শিক্ষার্থী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। মোদ্দাকথা, শ্রেণিকক্ষ প্রাণোবন্ত করে তোলার জন্য যা করা দরকার, সবকিছু প্রাকৃতিক উপায়ে করা উচিত। শিক্ষকের কৃত্রিমতা, কপটতা ও নিয়মানুবর্তিতার অভাব, শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক দাগ কেটে যায়। তাই ভারো শিক্ষক হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীর শিক্ষক আর্দশ মানুষ না হলে, শিক্ষকের শিক্ষাদান শত চেষ্টায়ও ফলপ্রসূ হয় না। এখন শিক্ষকতা পেশাটাকে যেহেতু সবাই সহজ মনে করে এবং জবাবদিহিতার যেহেতু সংকট রয়েছে, তখন বুঝতে হবে জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে সাচিবিক ডেস্কে অথবা মগজহীন প্রভাবশালী মানুষের টেবিলে। সুতরাং, শুধু পরীক্ষা কক্ষভিত্তিক শিক্ষা নয়, ডেস্কভিত্তিক সিদ্ধান্তে জাতিগঠন নয়, শ্রেণিকক্ষ ও আদর্শ পরিবারভিত্তিক শিক্ষা ও সমাজ গড়ে উঠুক, এটাই আমাদের কামনা।