ভূমিকম্প : বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটুকু?

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভূকম্পন দেখা যায় না, তবে অনুভব করা যায়। ভূমিকম্প প্রকৃতির শক্তিশালী ও ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেদিক থেকে বলা যায়, মানবসভ্যতা বিধ্বংসকারী নিষ্ঠুরতম প্রকৃতির প্রতিশোধের রূপ ‘ভূমিকম্প’। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হলেও মাটির নিচের এই দুর্যোগে মানুষের কোনো হাত নেই। শুধু রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। এই যন্ত্রের নাম সিসমোগ্রাফ। টেকটোনিক প্লেট একটির সঙ্গে অন্যটির ঘর্ষণের কারণে একটি প্লেট অন্য প্লেট থেকে সিøপ করলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর বহু ধ্বংসলীলার কারণ ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কারণে সুনামি-জলোচ্ছ্বাস-সাইক্লোন, নদী প্লাবন, ভূমিধ্বস, ফাটল-ভরাট ও গর্তের সৃষ্টি করে। ভূমিকম্প জীবন ও সম্পদ নষ্ট করে। বাংলাদেশের অবস্থান ভৌগোলিক কারণে ইন্ডিয়ান ও ইউরোপিয়ান প্লেটের সীমানায় হওয়ায় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শুক্রবার গভীর রাতে মরক্কোর হাই এটলাস পর্বতমালায় ৭ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে মরক্কোর বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মরক্কোতে ভূমিকম্পে প্রাণহানি ২ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ভোরে সিরিয়া-তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জাপানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয়। দেশটি ভূমিকম্পপ্রবণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ‘রিং অব ফায়ারে’ অবস্থিত। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। গত ১ বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। বেশির ভাগের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫–-এর মধ্যে। এতে মৃদুকম্পন ও কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হওয়া ছাড়া তেমন ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা যায়নি। ভূমিকম্প মূলত বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই এ ধরণের ভূমিকম্প বাংলাদেশ প্রায় হচ্ছে। এই দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে। যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আর সে কারণেই ঘন ঘন এমন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। টেকনোকেট প্লেট সিলেটে অবস্থানরত ক্রমেই পূর্বদিকে সরে যাচ্ছে এবং ১০০ বছরে ১ মিটার সরে যায়। ডাউকি ফল্টে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে এবং ৮ মাত্রার হলে এই অঞ্চল জনশূন্য হয়ে যাবে। দেশের বিভিন্ন জেলায় যত্রতত্র ভবন তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূকম্পনের লক্ষণ। ইদানীং সিলেট-ছাতক, খুলনাসহ কয়েক দফা মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভূমিকম্পের আঘাতের চেয়ে উঁচু ভবন থেকে নামার সময় তাড়াহুড়া করে অনেক বেশি প্রাণহানী ঘটে। বাংলাদেশের ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকাজ পরিচালনায় তেমন কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি এর আগে ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১৯ সালে ২২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। এই খাতে আরো বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাংলাদেশর অনেক উপজেলার এখনো ফায়ার স্টেশন নেই।

বাজারে বিদ্যমান নিম্নমানের বিল্ডিং নির্মাণ উপকরণ রড-সিমেন্ট উৎপাদনে অনেক ভেজাল থাকায় ভবন ধসে পড়ে। ভূমিকম্প রোধ করা মানুষের অসাধ্য। তবে সরকারের পাশাপাশি দেশের মানুষ সতর্ক ও সচেতন হলে ভয়াবহ প্রকৃতির এই তাণ্ডব থেকে প্রাণ রক্ষা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বা বন্ধ করার সুযোগ নেই। তবে সচেতনতা ও সতর্কতার মাধ্যমে ক্ষয় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। ভূমিকম্প থেকে রক্ষায় সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে— দেশের সব হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত রাখা। দেশের সব রড, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোতে নির্ভেজাল পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা। পুরাতন জরাজীর্ণ ভবন, ছাদের ঢালাই ইট খসে পড়া, ইটের তৈরি ফাউন্ডেশনের ভবনে বসবাস না করা। প্রতিটি নতুন ভবন তৈরিতে বিল্ডিং কোড মেনে চলা। নামার সিঁড়ি বড় করে রাখা। পাকা ও আধা পাকা কাঁচা ঘরের ছাদে ভারী জিনিস না রাখা। বাড়ির আঙিনায় প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা রাখা। ভবন বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে হলে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিশ্চিত করা। ভবনের নকশা অনুমোদন এবং অনুমোদন মোতাবেক ভবন নির্মাণ তদারকি নিশ্চিতকরণ। ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ। সবস্তরের জনপ্রতিনিধি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গ্রামে শহরে স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা। ভূমিকম্পের সতর্কতা ও সচেতনতার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া। শহর এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ দালান চিহ্নিত করে লোকজন বসবাসে নিষেধাজ্ঞা জারি করা। সর্বাবস্থায় ভূমিকম্প থেকে বাঁচতে হলে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ভূমিকম্পে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ যে কোনো সময় আবার আঘাত হানতে পারে ভূমিকম্প। প্রকৃতি আমাদের বারবার সতর্ক করছে। কিন্তু আমরা সাবধান হচ্ছি না। ফলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা আমাদের ঘিরে রাখছে। আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এদেশের আয়তন ও ঘনবসতিসহ সামগ্রিক বিবেচনায় পুরো বাংলাদেশই প্রবল ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষত রাজধানী ঢাকা শহরের লাখ লাখ পুরোনো, জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্চমাত্রার যে কোনো ভূমিকম্পে অনেক মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই বিপর্যয়ের শিকার হতে পারি আমি, আপনি আমাদের পুরো পরিবার। এখন সিলেট ও ঢাকায় ভূমিকম্প সতর্কতা ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে মনোযোগ দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশ হবে, একটি ভূমিকম্পে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মরক্কো, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, জাপানসহ অনেক দেশ থেকে আমাদের পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ হতে পারে। কারণ আমরা ঘন জনবসতির দেশ। আবার জলাভূমি ভরাট করে যেনতেনভাবে ভবন করেছি প্রতিনিয়ত। ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার মতো আমাদের ঝুঁকির অনেক কারণ আছে।

ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে এখনই আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬ থেকে ১০ সেকেন্ড আগে যেন সতর্কসংকেত যথাসময়ে পৌঁছে দিতে পারি জাতীয়ভাবে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীকে এ ধরনের দুর্যোগের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার উপযোগী ও সক্ষম করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। সচেতনতাই হতে পারে ভূমিকম্প মোকাবিলার অন্যতম একটি প্রস্তুতি।

শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।