ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুন্দর আচরণে মানুষ

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
সুন্দর আচরণে মানুষ

মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কথা এক চমৎকার শিল্প। এই শিল্পগুণে যে যত এগিয়ে, জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারে পার্থিব সুবিধা, সে তত সহজেই নিজের করে নিতে পারছে। কালে কালে মানুষ নিজের প্রতি অন্যকে মুগ্ধ করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছে। রপ্ত করছে অলঙ্কার শাস্ত্র। কেউ কথাকে ছোট ও আকর্ষণীয় করে অন্যের সামনে উপস্থাপন করছে। আবার কেউ কথার মাঝে প্রকাশ করছে সাহিত্যের অনুপম ব্যবহার। কেউবা কথামালাকে শ্রোতার উপযোগী করে তার মন জয় করে নিচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই, অন্যের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলা। কখনো কখনো মানুষ নিজের আলাপ-ব্যবহারে অন্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করে, যে আকর্ষণ বলয় থেকে সে কখনো বেরিয়ে আসতে পারে না। নিজের অগোচরেই হয়, সে তাকে আইডল বানিয়ে নেয়। অথবা প্রিয় বন্ধুর আসনে বসিয়ে দেয়। কী চমৎকার শক্তি এই কথায়! এই ভালো গুণটি রপ্ত করতে নিজেকে সভ্য করুন। কারণ মানুষের সভ্য আচরণগুলো মানুষকে ভদ্র করে। জ্ঞান অর্জন করুন। তবে সেই জ্ঞান যেন সবসময় বিনয়পূর্ণ হয়ে থাকে। জ্ঞানের সঙ্গে ভদ্রতার সংমিশ্রণ না ঘটলে সেই জ্ঞান কখনোই অন্যের কাছে সমাদৃত হয়ে উঠে না। যে জ্ঞান মানুষের মধ্যে আচরণিক পরিবর্তন আনতে পারে না, সেই জ্ঞান মানুষকে খুব একটা প্রকাশযোগ্য করে তুলতে পারে না। তাই নিজের আচরণে নিচের প্রতিবিম্ব খোঁজার চেষ্টা করুন এবং সেটা ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কাজে লাগান। তাহলে আপনার সুবাসিত শব্দচয়ন, মার্জিত আচরণ, উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের উত্তম ব্যবহার আপনাকে সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। পরিবেশ অনুযায়ী জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করাই জ্ঞানীর কাজ। যে পরিবেশে জ্ঞান প্রতিবাদের দাবি, সেখানে মৌনতা কখনোই জ্ঞানের বিনয়পূর্ণ আচরণ নয়। আপনি নিজের মধ্যে আচরণিক পরিবর্তন সাধন করে চলছেন। আপনি একজন মানুষ, তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে আপনার অবস্থান একটু ঊর্ধ্বে। এটি আপনার অহঙ্কারের বিষয় নয়, সংশোধনের সময়। এই সময় যদি আপনি অহমিকার জগতে প্রবেশ করেন, আপনার ধ্বংস অনিবার্য। আত্ম সংশোধনের জন্য চাইলে আপনি কনফুসিয়াসের এই উক্তিটি আমলে রাখতে পারেন- ‘অন্যের যেরূপ ব্যবহারে নিজে বিরক্ত হও, অন্যের প্রতি ভুলেও সেরূপ ব্যবহার করিও না।’ আপনি যখন এই আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন, মানুষের পক্ষ থেকে খুব কম অভিযোগই আপনার দিকে আসবে। মনুষ্য জগতে আপনি ফেরেশতা হয়ে থাকলে সবাই আপনাকে ভালো বলবে না। তবে আপনাকে কেউ মন্দ বললে, সেই মন্দের কারণ শনাক্ত করুন। এবার কারণটিকে বিচারের মুখোমুখি করুন। যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়, কালবিলম্ব না করে কাজটিকে পরিশুদ্ধ করে নিন। আপনি অন্যের কাছে জনপ্রিয় হতে চাইলে আপনার আচরণকে অবশ্যই পরীক্ষার সম্মুখীন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি যখন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবেন, ক্রমেই মানুষও আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। সুতরাং ভালো কাজের বিনিময় ভালো দিয়েই পরিশোধ করুন। মানুষের অনিষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন। ভালো কাজকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করবেন না। সে আপনার দৃষ্টিতে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন। ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একদিন মানুষের জন্য অনেক বড় ফায়দা নিয়ে আসে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘হাসিমুখে অন্যের সঙ্গে কথা বললে সেটিও একটি সদকা দেওয়ার সমান সওয়াব হয়ে যায়।’ তাই আপনার কথাকে মানুষের জন্য প্রশান্তিদায়ক করে উপস্থাপন করতে হবে। এমনভাবে কথা বলবেন না, যে কথা অন্যের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে আপনার খুব প্রিয়ভাজনও একদিন আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন- ‘আপনি মানুষের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলুন।’ সুতরাং কথা এমন এক শক্তি, যা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। তাই কখনোই কথাকে অন্যের জন্য বেদনাদায়ক করে তুলবেন না। কথার সৌন্দর্য হারিয়ে কথা বলবেন না। কথার আদব সম্পর্কে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অহঙ্কার বশে তুমি কখনো মানুষের জন্য তোমার গাল ফুলিয়ে রেখে তাদের অবজ্ঞা করো না। তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো, অবশ্যই আওয়াজগুলোর মধ্যে সবচাইতে অপ্রীতিকর আওয়াজ হয়ে গাধার আওয়াজ।’ ভালো ব্যবহার কেন করব? করব কারণ, আমরা যা কিছু করি সবকিছুর পেছনেই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। আপনার উদ্দেশ্য আপনাকে দুই ধরনের উপকার এনে দিতে পারে। এক. আপনি দুনিয়ায় এর প্রতিদান পাবেন। দুই. দুনিয়ার পাশাপাশি আপনি পরকালেও এর দ্বারা লাভবান হবেন। যদি আপনার কাজগুলো আপনার আল্লাহকে খুশি করার জন্য হয়ে থাকে, তাহলেই আপনি উভয় ফায়দা পেয়ে যাবেন। সুতরাং নিজের ইচ্ছেকে মজবুত করুন। নড়বড়ে ভিত্তির ওপর কখনোই নিজের সংকল্পকে দাঁড় করাবেন না। আপনি যদি আপনার ব্যবহারকে মানবিকতা ও কোরআন-সুন্নাহর শিক্ষায় গড়ে তুলে পারেন, আপনার এই পরিশ্রম কখনোই মূল্যহীন হয়ে পড়বে না। আল্লাহ কখনোই মানুষকে তার কাজের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করেন না। আপনার ব্যবহার আপনার মৃত্যুর পরেও আপনার গ্রহণযোগ্যতা সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। আপনার মৃত্যুর পরে সবাই যদি আপনাকে ভালো বলে, আপনার স্মরণে নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়, এই ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার প্রমাণ। স্বার্থ নিয়ে তৈরি ভালোবাসা কখনোই চোখের অশ্রু ঝরাতে জানে না। মেকি কান্না ও মহব্বত কখনোই এক নয়। অপরকে খুশি করার জন্য কত দোয়া-মোনাজত আমরা করি, কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন এই দোয়া মোনাজের কয়েক ফোটা চোখের পানি যোগ হয়। কিন্তু আপনি যখন আপনার মা-বাবার জন্য পরম করুণাময়ের দরবারে হাত তোলেন, তাদের কথা স্মরণ হতেই ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। আপনাকে অন্তরের টান বুঝতে হবে। মানুষের সঙ্গে এমন ভালোবাসা তৈরি করুন। এজন্য যে ছাড় দিতে হয় সেটুকু দিতে শিখুন। সুতরাং আচরণকে একান্ত নিজের জন্য করে নিন। আজ অ্যাডওয়ার্ড জনের একটি উক্তি দিয়েই শেষ করতে চাই- ‘মৃত্যুর পরে যার জন্য মানুষ মানুষের হৃদয়ে অমøান হয়ে থাকে, সে হচ্ছে তার ব্যবহার।’ আসুন সেই ব্যবহার দিয়ে জীবন সাজাই।

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত