ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে

মো. খসরু চৌধুরী
বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে

বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে ইতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। তাদের মূল্যায়ন ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির একটি দেশ হবে। এ তালিকায় বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়াও থাকবে। ফলে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠবে আকর্ষণীয় গন্তব্য। বাংলাদেশের বাজারের আকার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে এ পূর্বাভাস দিয়েছে ইআইইউ। প্রতিবেদনে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, টেলিযোগাযোগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও গাড়ির কথা বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদনটি করা হয়েছে মূলত চীনের বিনিয়োগকারীদের বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো দেশগুলো আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে, সে সম্ভাবনার নিরিখে।

চীনের বহুল আলোচিত অঞ্চল ও পথ উদ্যোগ দ্বিতীয় দশকে পদার্পণ করেছে। সে উপলক্ষ্যে চীনের বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি র?্যাংকিং করেছে ইআইইউ। সে দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বাদশ। এক দশক আগে ২০১৩ সালেও এমন একটি র?্যাংকিং করা হয়েছিল এবং তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫২তম। অর্থাৎ গত এক দশকে চীনের বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। মাত্র এক দশকে ৫২তম স্থান থেকে ১২তম স্থানে উঠে আসা তার প্রমাণ।

এ ক্রমতালিকার বাজার সম্প্রসারণমূলক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তালিকায় প্রথম স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া। এরপর ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, মিসর, ভারত ও তানজানিয়া। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী একটি দেশ। বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃস্থানীয় দুই দেশ চীন ও ভারতের মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধন ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত। এ মৈত্রীর বন্ধন জিইয়ে রেখে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে গড়ে তুলেছে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বেও নীতি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে তিন চালিকাশক্তি। এগুলো হলো- কৃষি, গার্মেন্ট এবং রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়)। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্স থেকে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। দেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাতের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই পোশাক খাতের। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরির ক্ষেত্রেও রেমিট্যান্সের বিশাল অবদান আছে। দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান এবং তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এ খাত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে। এ ছাড়া পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর কৃষিতে এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে গত ১৫ বছরে পোলট্রি, গবাদি পশু এবং মাছ চাষে বিপ্লব হয়েছে। স্বাধীনতার পর গত ৫২ বছরে পোশাকশিল্প দেশকে অনেক দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান এ খাতের। এ খাতকে আরো এগিয়ে নিতে টেকসই নীতি দরকার। গ্যাস, বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, দীর্ঘমেয়াদি করনীতি এবং পণ্যের বহুমুখীকরণ জরুরি।

আজকের যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, তার পেছনে প্রবাসীদেরও অবদান রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশকে ধরা হয়। আমরা যতগুলো বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছি, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের কারণে সেখান থেকে রক্ষা পেয়েছি। প্রতিবছর দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তার ১০ থেকে ২০ গুণ প্রবাসীরা পাঠান। ২০ বছর আগেও বাজেট করতে সরকারকে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হতো। বর্তমানে আমরা শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছি। অনেক বিশাল অর্জন।

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একই সঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। পোশাকশিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে অন্যান্য শিল্প বিপাকে পড়লেও সবার আগে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। দেশে রপ্তানি খাতে ৮৫ শতাংশ অবদান রাখছে তৈরি পোশাক। রপ্তানি খাতে সুপারস্টার তৈরি পোশাক। আমাদের রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আসছে। নতুন পণ্যের ক্ষেত্রেও যেমন ম্যান মেড ফাইবার ও হাই ভ্যালু প্রডাক্ট পোশাক খাতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এ ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প একধাপ এগিয়ে। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রপ্তানি-বাণিজ্যেও তৈরি পোশাকশিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প।

এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের মান এবং ডিজাইন আধুনিক করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পে কিছু বিদেশি দক্ষ কর্মী ছিল, এখন আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীরাই কাজ করছে। শিল্প বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। অনেকগুলোর কাজ এখন শেষপর্যায়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব-বাণিজ্যে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বমানের ও আধুনিক তৈরি পোশাক তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম।

বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প এক নতুন সম্ভাবনাময় সংযোজন। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে।

বেকার সমস্যা সমাধান বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান বাংলাদেশে বস্ত্রশিল্প-সংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাকশিল্পের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পোশাকশিল্পের প্রসারের পথে বিরাজমান যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ শিল্পের উত্তরণে এগিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট সবার অন্যতম দায়িত্ব।

লেখক: পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত