ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এ যুগেও ভণ্ড দরবেশ!

চিন্তা-চেতনায় থাকতে হবে বিজ্ঞানমনস্কতা
এ যুগেও ভণ্ড দরবেশ!

আমাদের সমাজে প্রতারণার ক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। কে কখন কোন প্রতারকের খপ্পরে পড়ে যায়, তা কারো পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। মানুষ স্বাভাবিকভাবে মানুষকে বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসের ওপরই আমাদের এই সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। এই বিশ্বাস না থাকলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত না। তবে কখনো কখনো এই বিশ্বাস মানুষকে সর্বশান্ত করে দেয়। কে আসলে উপকারী সজ্জন, আর কে প্রতারক, তার কোনো মাপকাঠি আমাদের সমাজে নেই। তবে যদি কেউ অকল্পনীয় ‘অসম্ভবকে সম্ভব’ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আর্থিক দিকটার ওপর নজর দেয়, তাহলে আঁচ করতে হবে সামনে সমূহবিপদ। আমাদের সমাজে রাস্তাঘাটের দেয়াল কিংবা পরিবহণের গায়ে নানা রকম লিফটলেট সাঁটানো থাকে। সেখানে নানা রকম চটকদারি কথাবার্তার মধ্যদিয়ে কাউকে চাকরি পাইয়ে দেওয়া, লটারি জেতানো, কারো স্বামীকে বশে এনে দেওয়া, বাচ্চা না হওয়া নারীকে সন্তান ধারণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বিনিময়ে হাদিয়া। আর সেই হাদিয়া প্রথমে হাজার টাকা হলেও পরবর্তীতে তা লাখ এবং কার্যক্ষেত্রে কোটি টাকায় পৌঁছায়। এমন একজন ভণ্ড দরবেশকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দরবেশ পরিচয়দানকারী ভোলার হাসেম বোরহান উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করার পর থলের বিড়াল বের হয়ে আসে। তিনি বিভিন্ন ভাষা রপ্ত করার পাশাপাশি মানুষকে সম্মোহন করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। ২০১৬ সাল থেকে নিজেকে পুরোপুরি দরবেশ পরিচয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। গত ১৮ বছরে অন্তত ৫০ কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়েছেন তিনি। এ টাকায় গ্রামে করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, ঢাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট ও গাড়িও। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি নার্স আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে স্বামীকে বশে আনার কথা বলে ১ বছরে ৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ভণ্ড দরবেশ হাসেমের প্রতারণার বিষয়টি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) নজরে আসে। ভণ্ড দরবেশের সহকারী তানজিলকে উত্তরা থেকে ও পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভোলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসেমকে। আনোয়ারা বেগমের তিন ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। স্বামী নামকরা চিকিৎসক। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায় ও ভুগছিলেন। স্বামীকে বশে আনার পথ খুঁজছিলেন তিনি। একদিন ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপনে দেখেন, সুন্দর-সৌম্য চেহারার দরবেশ বেশধারী ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধান করেন। আনোয়ারা বেগম দরবেশ বাবার কথা মতো বিকাশের মাধ্যমে ৭ কোটি টাকা হাদিয়া দেন। একসময় ভক্ত আনোয়ারার মোহ ভাঙে। বুঝতে পারেন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। প্রতিকার পেতে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। করেন সিআইডি’তেও অভিযোগ। সিআইডি প্রধানের নির্দেশে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভুক্তভোগী আনোয়ারার অভিযোগের সত্যতা পায়, শনাক্ত হয় কথিত দরবেশও। অবস্থান শনাক্তের পর ঢাকার উত্তরা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে প্রথমে অভিযুক্ত তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে জানা যায়, তিনি আসল দরবেশ নয়। তার বয়ানেই প্রথম উঠে আসে আসল দরবেশের ভণ্ডামি। তানজিল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চক্রের মূলহোতা হাসেম বোরহান উদ্দিন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আনোয়ারা বেগম অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা আর তার স্বামীও একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক। আনোয়ার বেগমের ধারণা ছিল, তার স্বামী তার বশে নেই। তাই তাকে বশে আনতে হবে। এই বয়সে স্বামীকে বশে আনা এবং ৭ কোটি টাকা কোনো প্রতারককে নির্দিধায় দিয়ে দেয়ার মতো মনমানসিকতা তিনি পোষণ করেন বলেই মনে করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- তিনি এত টাকার মালিক কীভাবে হলেন এবং স্বামীকে বশে আনার জন্য ৭ কোটি টাকা খরচ করার মতো মনোবাসনা তিনি কেন পোষণ করলেন, সেটাও ভাবার বিষয়। নিছক স্বামী কে বশে আনার জন্য এত টাকা ব্যয় করার মধ্যে হয়তো অন্য কোনো বিষয় থাকতে পারে। সেই সঙ্গে আনোয়ারা বেগমের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। আমাদের দেশের অনেক নারী তার স্বামীকে সন্দেহের চোখে দেখেন। স্বামীর প্রতিদিনের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। তার স্বামী তার মন মতো জীবনযাপন না করলে সন্দেহের চোখ প্রসারিত করেন। আমাদের এই ডিজিটাল যুগে সন্দেহ প্রবণতা যতটা বাস্তব তার চেয়ে বেশি বাস্তব মানসিক সমস্যা হিসেবে। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। সব কিছু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবতার নিরীক্ষে গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আনোয়ারা বেগমের মতো কোটি কোটি টাকা খেশারত দিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত