বীরদর্পে ঘুরে দাঁড়াল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

মিজানুর রহমান মিজান

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তখন দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দেয়। এর ফলে শ্রীলঙ্কার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তৎকালীন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে শ্রীলঙ্কা তার আমদানি ব্যয়টুকুও মেটাতে পারছিল না। ফলে দেশটিতে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা যায়। তবে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা সেই পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। আবারো জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি পর্যটন কেন্দ্রসমূহ। সেইসঙ্গে দেশটির রেমিট্যান্সও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। অনেকের কাছে প্রশ্ন হলো অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে কীভাবে আবারো তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনঃরুদ্ধার করল। শ্রীলঙ্কা দেশেটিতে যখন অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চলছিল তখন দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এসব দেশগুলোর জন্য পথ প্রদর্শক হতে পারে।

করোনা মহামারির ধাক্কায় শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক পতনের সূত্রপাত হয়েছিল। কারণ শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা পর্যটন কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। সেই সময় করোনা মহামারির সময়ে দেশটির পর্যটন খাত ধসে পড়ার পাশাপাশি প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যায়। তার ফলশ্রুতিতে শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালের শুরুর দিকে ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। তখন আবার শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। তার ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্য আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। একসঙ্গে এতগুলো ধাক্কা শ্রীলঙ্কা একসঙ্গে সামাল দিতে পারেনি। চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নজিরবিহীন গণআন্দোলনের মুখে পড়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যায় দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে। তারপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, শ্রীলঙ্কা এখনো পুরোপুরি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেশটি যখন তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবে তখন দেশটির প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। একটা সময় শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি করার মতো কোনো অর্থ ছিল না। ফলে দেশটির বেশিরভাগ দোকানেই ছিল না কোনো পণ্য। যেসব দোকানে সামান্য কিছু পণ্য ছিল সেসব দোকানের সামনে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ সারি। বর্তমানে দেশটির সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি হলেও দেশটিতে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ রয়েছে। ফলে মানুষের জীবন যাত্রাও আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শ্রীলঙ্কা মাত্র দুটি বিশেষ সুবিধার কারণে মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, বেশকিছু সরকারি নীতি আর দ্বিতীয়ত, কিছু প্রকৃতিগত বিষয়। সরকারি নীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে এবং সেইসঙ্গে দেশটির রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। সেইসঙ্গে খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি মূল্যের দাম কমিয়ে জন-জীবনকে সহজ করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য ২৩ লাখ অতি দরিদ্র মানুষকে নগদ অর্থিক সহায়তা দিয়েছে সরকার। তবে রণিল বিক্রমাসিংহে সরকার সব বিষয়ে জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো খাতে কর বাড়ানো এবং কিছু খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো কিছু পদক্ষেপ বেশ অজনপ্রিয় হয়েছে।

অন্যদিকে প্রকৃতিগতভাবে পরিবর্তনগুলোর মধ্যে পর্যটন কেন্দ্র এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স উন্নয়ন করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র থেকে আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৬ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময়ে আয় করেছিল মাত্র ৪৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসেই শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে ৮২৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বেড়েছে অনেক বেশি। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। গত বছর শ্রীলঙ্কার ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। এদের অনেকে ডাক্তার প্যারামেডিকেল কিংবা আইটি প্রোফেশনাল সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কা বিদেশে লোক পাঠানোর রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গত এক বছরে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে চালিত বছরের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।

সেইসঙ্গে কৃষি খাত ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সরকার তাদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ আইএমএফের মতো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাংক বেশ ভালোভাবে এগিয়ে এসেছিল। শ্রীলঙ্কায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্য থেকে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়। যা ওষুধ জ্বালানি এবং সারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে ব্যবহার করা হয়।

এর বাইরে দেশটির বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে সংকটকালীন সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি তথ্য মতে জানা যায় দেশটির বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও শ্রীলঙ্কার জিডিপি কিছুটা কমতির দিকে থাকবে। তবে ২০২৪ সাল থেকে দেশটির জিডিপি আবারো স্বাভাবিক হবে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষের দিকেই তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক হবে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। কোনো কোনো সংস্থার মতে এই ঋণের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হতে পারে। তারমধ্যে চীন, জাপান, ভারতকেই পরিশোধ করতে হবে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ।

মোট ঋণের মধ্যে আবার ২৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কর্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। শ্রীলঙ্কা যখন ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করবে তখন বোঝা যাবে তাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা এক বছরের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার সাম্প্রতিক সময়ে ফেরত দিয়েছে। সেইসঙ্গে খুব শিগগিরই আরো ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করার কথা রয়েছে।

দেশটির সংস্কার কার্যক্রম চালাতে গিয়েও সরকারকে বেশকিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছর সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ করে কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়াও দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতেও সরকারের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি খরচ কমানোর জন্য শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্স, শ্রীলঙ্কান টেলিকম এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে বেসরকারি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন ইউনিয়নগুলো সরকারের এসব পরিকল্পনার বিরোধিতা করে সরকারের এসব পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেওয়ার কারণে মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

যেমন শুধু মাত্র বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। সব বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে এবং দেশটিকে আবারো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শ্রীলঙ্কাকে হয়তো আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক উত্থান হতে পারে অনেক দেশের জন্য পথপ্রদর্শক।