বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক সুবিধাই সর্বজনীন পেনশন

আহসান হাবিব

প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যাত্রা শুরু করল সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্মসূচি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নাগরিকদের সুবিধার্থে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় বাংলাদেশ। সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্মসূচি বর্তমান সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। তবে এ স্কিম থেকে বাদ পড়ছেন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্ত ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ। তাদের সবাই নগদ ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন। তারা যদি সর্বজনীন পেনশন সুবিধা পেতে চান তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না বা এ স্কিমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। একই সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীরা আপাতত এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বল্প আয়ের নাগরিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা এতে অংশ নিতে পারবেন। এ কর্মসূচির মাধ্যমে বৃদ্ধ বয়সে এসে কোনো লোককে আর অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না। যা বৃদ্ধ বয়সে আর্থিক সুবিধা মানেই সর্বজনীন পেনশন। প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ পাস হয়। তবে ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে ১৩ আগস্ট এর বিধিমালা জারি করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশি বয়সিরাও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সুবিধা নিতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে- টানা ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। চারটি আলাদা আলাদা স্কিম আছে। স্কিমগুলো হচ্ছে সমতা, প্রগতি, প্রবাস ও সুরক্ষা। এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা (স্কিম) চালু করেছে সরকার। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় কত মানুষ পেনশন সুবিধার আওতায় আসবেন তা এখনো সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। তবে পেনশন স্কিমের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের সদস্যদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। একটু ঊনিশ বিশ হলেই অনেককেই হতে হচ্ছে বাড়িছাড়া। বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। আর এ কারণেই চালু করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩-এ এসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হলো। চাঁদার পরিমাণ সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। শুধু ‘সমতা’ স্কিমের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হবে এবং সরকার দেবে ৫০০ টাকা। নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। পেনশনাররা আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তবে কেউ যদি ৭৫ বছর বয়স পূরণ হবার আগেই মারা যান তাহলে তার নমিনি পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবেন। আর যদি পেনশনার ১০ বছর চাঁদা দেবার আগেই মারা যান তাহলে তার জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। কারো যদি পেনশনে জমাকৃত অর্থ কোনো এক পর্যায়ে উত্তোলনের দরকার হয় তাহলে সেই সুযোগও থাকছে এই কর্মসূচিতে। তার মোট জমার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ অর্থ তিনি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ হিসেবে নিতে পারবেন। পেনশনের জন্য প্রতি মাসে জমা দেওয়া চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হবে এবং সেই অর্থ কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে। আর মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ হবে আয়কর মুক্ত। দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৯টি শাখাই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের চুক্তি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকে কারো হিসাব থাকুক বা না থাকুক, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন। পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসতে গেলে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের এনআইডি নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে এই পেনশন স্কিমের আওতায় আসতে পারবেন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সাধারণত চাকরিতে অবসর গ্রহণের পর এবং তার মৃত্যুর পর তাদের স্ত্রী ও পরিবারবর্গের ভরণপোষণে বড় একটি সহায় হিসেবে বিবেচিত হয় পেনশন। কিন্তু বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে পেনশন প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো সরকারই এর আগে উদ্যোগ নেয়নি। চাকরিজীবী নন যারা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা স্বাধীন কোনো পেশাজীবী তাদেরও বৃদ্ধ বয়সে পেনশন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কথা মাথায় রেখে সরকারের পক্ষ থেকে সব নাগরিকের জন্য পেনশন প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। যা নাগরিকদের জন্য বৃদ্ধ বয়সে এক ধরনের আর্থিক নিশ্চয়তা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বৃদ্ধভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রভৃতি কর্মসূচি চালু করেছে। যার আওতায় দেশের শহর ও গ্রামের বিশাল জনসংখ্যার একটি অংশ সামান্য হলেও মোটামুটি এক ধরনের আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন সরকারের কাছ থেকে। কিন্তু জনসাধারণের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। সেটাও এবার চালু করল বর্তমান সরকার।

দেরিতে হলেও নির্বাচনি ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এর ফলে সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ অংশের নাগরিকরা যারা সরকারি চাকরি করেন না বা বেসরকারি চাকরি করেন বৃদ্ধ বয়সে নতুন এই স্কিমের আওতায় পেনশন লাভের সুযোগ পাবেন। পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের পর সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকারের হাত আরো শক্তিশালী হলো। বিগত সময়ে কোনো সরকারই এরকম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা কেউ চিন্তাই করেনি। তবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সরকারকে ভেবেচিন্তে এগুতে হবে। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামর্থ্য বিবেচনায় পেনশন তহবিলের মাসিক কিস্তি নির্ধারণ করতে হবে। সমাজের কারা কারা পেনশন সুবিধাভোগী হবেন, এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বাছাই করে নির্দিষ্ট কিছু নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করে যেন এই তালিকা তৈরি করা না হয়, সরকারকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকরি ছাড়াও বেকারদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে। সেখানে একজন কর্মী যখন চাকরি করেন, তখন তিনি কিছু অর্থ জমা রাখেন। যদি কোনোভাবে তিনি বেকার হয়ে যান তখন সরকার কিছু অর্থ যোগ করে ওই ব্যক্তিকে পেনশনভাতা দিয়ে থাকেন। এটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেখানে প্রতারণা কিংবা জমানো অর্থ পেনশন হিসেবে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরকম হয়রানির সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন সেরকম হয়। গরিবের জমানো টাকা লুটেরাদের হাতে যেন না যায়। পেনশন তহবিলে যারা টাকা জমা রাখবেন তারা যেন সঠিক জায়গায় ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার জন্য টাকাটা রাখতে পারেন- তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমানো টাকা যেন বেহাত, আত্মসাৎ বা লুটপাট হয়ে না যায় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি এবং রাষ্ট্রপ্রধানকেই এর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন বিশাল ক্ষতি ও ঘাটতির মুখে পড়তে না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।