ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অভিমত

উপকূল থাক পরিচ্ছন্ন

মুনতাসির মামুন
উপকূল থাক পরিচ্ছন্ন

মনে আছে এই তো কয়েক বছর আগে আমরা কক্সবাজারকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি করার জন্য ভোট দিয়েছিলাম। হয়তো মনে আছে। সেই প্রচারে কক্সবাজারের নাম আমাদের গণ্ডি ছেড়ে আরো দূরদূরান্তে গেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। সারা দুনিয়ায় মিয়ামি বিচের মতো পরিচিতি না পেলেও বেশ পরিচিতি পেয়েছিল অবধারিতভাবে। আমরাও হামলে পড়েছিলাম। লাখ লাখ মানুষ কক্সবাজার যাওয়া শুরু করল দেশের আনাচেকানাচে থেকে। পর্যটনের চাপে আলুভর্তা, ডালভাতের প্লেটের দাম উঠে যায় ৩০০ টাকা। এটা বাড়িয়ে বলা নয়; পত্রিকায় পড়া। তার মানে প্রচারেই যে প্রসার হয়, তার উদাহরণ কক্সবাজার। খুব সাধারণভাবে বলা হলে, বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব প্রায় পুরোটাই আসলে উপকূল। উপকূল বলতে সি-বিচ ভাবার একটা তাড়না আমাদের আছে। তা নিছক কক্সবাজারের অতি জনপ্রিয়তা বা অতি প্রচারের জন্য হতে পারে। আমরা যেমন পাহাড় বলতে এভারেস্ট বুঝি, উপকূল বলতে কক্সবাজারই বুঝি। কিন্তু আসলে এর ব্যাপ্তি অনেক বড়। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরমুখী মূল ভূখণ্ড পুরোটাই উপকূল; যার খুবই ছোট একটা অংশ কক্সবাজার সমুদ্রোপকূল।

এত কিছু কেন বলা হচ্ছে সে কথায় আসা যাক এবার। উপকূলের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বেশ কিছু দশক ধরেই সারা দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছে। আমাদের এখানেও হচ্ছে। উপকূলের পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ার কারণ হলো মাত্রাতিরিক্ত বর্জ্য। বর্জ্য যদিও অনেক ধরনের হতে পারে, তাই যদি শুধু প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্যের কথা বলা হয়, তবে তা সহজে অনুমেয়। প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। এটা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ, নিত্যনৈমিত্তিকভাবে আমরা প্লাস্টিকে মোড়া পণ্যের প্রতি নির্ভর হয়ে পড়ছি বা পড়ে গেছি। বাজারসদাইয়ে এমন কোনো পণ্য বাকি আছে যার মোড়ক প্লাস্টিকে নয়? এর উত্তর আমরাই দিতে পারি। প্রশ্ন হলো, এমন অবস্থা কি ছিল? বছর কুড়ি বা তারও আগে হয়তো এতটা ছিল না। খোলাবাজার বলতে আদতে সেই বাজারকেই বোঝানো হতো, যেখানে মোড়ককৃত নয় এমন পণ্য খরিদ করা যেত। কিন্তু এখন সেই একই পণ্য কি মোড়ক ছাড়া পাওয়া যায়? বেশিরভাগই যায় না। এর কারণও আছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এর একটা বড় কারণ হতে পারে। বাজার অর্থনীতিও হতে পারে। অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের কমফোর্টকেও জুড়ে দেওয়া যায়। এ কমফোর্টের জন্যও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে বা আরো বাড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। উপকূলের সঙ্গে মোড়কের সম্পর্ক ঠিক কোথায়, তা কক্সবাজার বা যে কোনো উপকূলবর্তী অঞ্চল, যেখানে মানুষ বসবাস করে বা পর্যটনের প্রচার-প্রসার আছে, তেমন কোনো একটা জায়গায় গেলেই খালি চোখে দেখতে পাওয়া যায়। এ আবর্জনার মূল উৎপাদক আসলে আমরাই। সমুদ্রোপকূল শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা দুনিয়ার মানুষের কাছেই ভ্রমণের জন্য অন্যতম আগ্রহের স্থান। তাই লাখ লাখ মানুষ সমুদ্রোপকূল বা সি-বিচে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কক্সবাজারসহ আরো যত সি-বিচের নাম আমরা বলতে পারব, তার সবখানেই আমরা যাব এটাই সাধারণ। কিন্তু পর্যটনের জন্য পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন হয়, তার সম্যক ধারণা আমাদের আছে কি না সেটাই প্রশ্ন। অনেকে মনে করেন ‘আরে কিছু ময়লা থাকলেই কী?’ সমস্যার শুরু এখানেই। আমরা হয়তো জানি না নদীনালা-খালবিল, সাগর-মহাসাগরের আবর্জনাজনিত সমস্যা নিয়ে এখন সারা দুনিয়ার যে মাতামাতি, তার শুরুই ‘কিছু ময়লা থাকা নিয়ে’। পর্যটনের জন্য উপকূলে বেড়াতে যাওয়া মানুষের ফেলে আসা ময়লা-আবর্জনা, যাকে বলা হয় ‘অ্যানথ্রপোজেনিক মেরিন ডেবরি’ই হলো উপকূলসহ সমুদ্রদূষণের প্রধান কারণ। আমরা ভাবতেই পারি, একটা চিপসের প্যাকেট ফেলে এলে আর কীইবা হতে পারে। এখানে ফেলে আসা প্যাকেটের সংখ্যা একটা বড় ব্যাপার। আবার ফেলে আসা চিপসের প্যাকেট বা যে কোনো ধরনের প্যাকেট/মোড়ক বা প্লাস্টিকে তৈরি যেমন সিগারেটের ফিল্টার সময়ের সঙ্গে বাতাসের ধাক্কায় পানিতে গিয়ে পড়ে। এ পানি আমাদের বাড়ির পাশের নদী হলেও যা, কক্সবাজারের সমুদ্রও হলেও তাই। পানিতে পড়লে তা পানির উপরিভাগে যতদিন থাকে ততদিন রোদে পুড়তে থাকে। এতে প্লাস্টিকের আন্তরাণবিক গঠনে পরির্বতন আসে। এ সত্য আমরা সবাই জানি। পানি গরম হলে বাষ্প হয়। তাই পানিতে পড়া প্লাস্টিকের কোনো কিছুর ভঙ্গুরতা বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মানে নরম হওয়া শুরু করে। এতে অবশ্য সময় লাগে। কিন্তু শেষমেশ এটাই হয়। একটি প্লাস্টিকের মোড়ক বা পণ্য ভাঙতে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হতে থাকে। এটা এত ছোট হতে পারে যাকে আর চোখে দেখাও সম্ভব হয় না। একে তখন বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক; যা পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। আর পানিবাহিত হয়ে তা জলজ পরিবেশ দূষিত করে। যেমন আমরা এখন প্রায়ই শুনি মাছের মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, মানুষের মল, বুকের দুধে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ আপনার আমার ফেলে দেওয়া সিগারেটের ফিল্টার, খাবারের মোড়ক, একবার ব্যবহার্য্য থালাবাটি, চায়ের কাপ, আর যত যা আছে যা আমরা ফেলে আসি, যা প্লাস্টিকে তৈরি তার সবই। তাই সারা বিশ্বে উপকূল বা সমুদ্রসৈকতে কোনো কিছু না ফেলার বাধ্যবাধকতা আসছে। সামনে হয়তো আরো আসবে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। সরকার উপকূল অঞ্চলে একবার ব্যবহারযোগ্য বা সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকে তৈরি বাসনকোসনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়তো খুবই কঠিন। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এ জাতীয় উদ্যোগ খুব একটা সুফল আনবে না, যদি তার বাস্তবায়ন না হয়। যে দেশগুলো জনবহুল নয়, সেখানে বর্জ্যব্যবস্থাপনা হয়তো তুলনামূলক সহজ। উপকূলের পরিবেশ তথা জলজ পরিবেশ (নদী থেকে সাগর সব জলাধার) দূষণের জন্য স্থলের বর্জ্যের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় জলজ পরিবেশ দূষণের ৮০ ভাগ ঘটে স্থলভাগের বর্জ্যব্যবস্থাপনার ওপর। তার মানে হলো, আমরা সি-বিচে যদি কিছু ফেলি তা থেকে সমুদ্রদূষণের আশঙ্কা পুরোটাই, যদি তা তুলে না নিয়ে আসা যায়। বাংলাদেশের উপকূল বা সৈকতে সব থেকে বেশি পাওয়া বর্জ্যের মধ্যে প্রথমে আছে সিগারেটের ফিল্টার। তারপর খাবারের মোড়ক, পানীয় বোতল, বাসনকোসন, স্টাইরোফোম জাতীয় পণ্য। এগুলোর আরো শ্রেণিভাগ আছে তবে মোটা দাগে এভাবেই বলা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত