বজ্রপাত প্রতিরোধে তালগাছের ভূমিকা

মোঃ জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ কবিতাটির সঙ্গে আমরা সবাই অনেকেই পরিচিত। তালগাছের নানা উপকারিতার কথা আমরা সবাই কমবেশি অবগত। বাংলা ও বাঙালির জনপ্রিয় ফল তাল। তাল দিয়ে তৈরি নানা স্বাদের পিঠা ও পায়েস এবং তালের কাঁচা পাকা শাঁস অনেকের খুব পছন্দের খাবার। ‘ভাদ্র মাসের তাল না খেলে কালে ছাড়ে না’ বলে একটি প্রবাদও আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে, বজ্রপাত তত বাড়বে। গত ৪০ বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই তালগাছই এখন মানুষের অন্যরকম উপকারে আসছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে এবং বজ্রপাত প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কাজ করছে।

জানা যায়, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা-আঁটি রোপণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর সারা দেশে বিশেষ করে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক বছর ধরে দেশে সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ষা ও সারা বছরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় ইউনিয়ন ফর সেক্রিফাইস অ্যান্ড হিউম্যান এইড নামের একটি মানবিক সংগঠন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে ও পরিবেশে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ১০ হাজার তালের বীজ রোপণ করেছে। পাশাপাশি তালগাছের উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে সচেতনতা সভারও আয়োজন করা হয়। সংগঠনটি বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি ও বিভিন্ন সংগঠনের তালগাছ রোপণ কর্মসূচির পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিটি বাড়িতে দু-চারটি করে তালগাছ লাগানোর আহ্বান জানায়।

বজ্রপাতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মৃত্যুই বাংলাদেশে ঘটছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের হাওর-বাঁওড় ও বিলপ্রবণ জেলায় বজ্রপাতের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে একসঙ্গে ১৭ জনের বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। উত্তরাঞ্চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। পদ্মা নদীর ঘাটে হঠাৎ বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হলে ওই ১৭ জন নদীর ঘাটে টিনের দোচালা ঘরে আশ্রয় নেন। সেখানেই বজ্রপাত হলে একসঙ্গে তাদের মৃত্যু হয়। জানা গেছে, মার্চ থেকে অন্তত ৩ মাস বোরো আবাদে হাওরে বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকে। ওই সময় বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি ঘটে।দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যুবরণ করেছে ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। ২০১১ সালে ১৭৯, ২০১১ সালে ২০১, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৬ সালে ২০৫, ২০১৭ সালে ৩০১, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৬৮ এবং ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছে ২৩৬ জন। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে প্রতি বছর গড়ে ২৬৫ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আর ২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে ২৭৪ জন মারা গেছে। প্রতি বছর মার্চ থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাতে ৩৪০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই মাঠে থাকা কৃষক, সাড়ে ১৪ শতাংশ বাড়ি ফেরার পথে, আর ১৩ শতাংশ গোসল কিংবা মাছ শিকারের সময়। তবে শহরের ভবনগুলোতে বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১ হাজার ৮৭৮ জন এবং তাদের ৭২ শতাংশই কৃষক।

অবশ্য পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের আবহাওয়ার উপযোগী করে বিভিন্ন বজ্রনিরোধক যন্ত্র ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ বা ব্যবস্থা তৈরির পর তা ব্যবহার করে আসছে। সবচেয়ে শক্তিশালী বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় উড়োজাহাজে। আমাদের দেশে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বা ব্যবস্থা ব্যবহার করে বজ্রপাতের ফলে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। লাইটনিং অ্যারেস্টার বা সার্জ ডাইভার্টার হলো এক ধরনের প্রটেকটিভ ডিভাইস, যা পাওয়ার সিস্টেমে হাইভোল্টেজ সার্জকে সারাসরি মাটিতে প্রেরণ করে। এটির প্রধান কাজ হচ্ছে লাইনে বজ্রপাত হলে তাকে সরাসরি মাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া। এজন্য লাইটনিং অ্যারেস্টারকে আর্থ করতে হয়। তালগাছ রোপণের মাধ্যমে বজ্রপাত নিরোধ সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় সম্প্রতি সরকার ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৫টি জেলার ১৩৫টি উপজেলা বজ্রপাতপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেসব স্থানে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। বজ্রপাত একটি আকস্মিক ঘটনা, যা প্রতিরোধ করা অত্যন্ত কঠিন। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, বজ্রপাত কখন কোথায় পড়বে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই বজ্রঝুঁকিতে রয়েছে। বজ্রপাত আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো, খোলামাঠ, রাস্তার পাশে এমনকি বিল, হাওর-বাঁওড় ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে উঁচু তালগাছ লাগাতে হবে। তাল, নারকেল, সুপারি প্রভৃতি উঁচু গাছ লাগানো যেতে পারে। তালগাছ বজ্রপাত নিরোধ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ও অনেকটা কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ, তালগাছের বাকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক। তালগাছের পাশাপাশি নারকেলগাছ, সুপারিগাছের মতো উচ্চতাসম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকর। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বজ্রপাত শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি নারকেলগাছ, সুপারিগাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।

সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়া ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা, ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার অবকাঠামো, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে তালগাছের রয়েছে সফল প্রয়োগ। তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি।

তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তার দুপাশে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত জায়গায় তালবীজ বপন করি। নিজে ও গ্রামের সবাইকে সচেতন করি, তালবীজ বপনে উদ্যোগী করে তুলি, এতে মানুষসহ পশুপাখি বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আর বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। বেশি করে তালগাছ লাগাই, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাই।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তালবীজ রোপণের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং মানুষ ও গবাদি পশু সুরক্ষায় থাকবে। গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে তালগাছের পরিকল্পিত চাষে নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ তুলে ধরে তালগাছে প্রকৃতি সাজাই, জীবন বাঁচাই। সারা দেশে গড়ে উঠুক তালগাছে প্রকৃতির সবুজ বেষ্টনী।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক