ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই

মো. রায়হান আলী
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই

ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন বর্তমান সময়ের একটি দুরদর্শী ও সাহসী চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আগামী ৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। আমরা এখানেই থেমে থাকিনি, ২১০০ সালের বদ্বীপ কেমন হবে- সে পরিকল্পনাও নিয়েছি। স্মার্ট বাংলাদেশে প্রযুক্তির মাধ্যমে সবকিছু হবে। সেখানে নাগরিকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে এবং এর মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতি পরিচালিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার এবং সমাজকে স্মার্ট করে গড়ে তুলতে এর মধ্যেই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে তরুণ প্রজন্মকে সৈনিক হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের সৈনিক হিসেবে তোমাদের (তরুণদের) স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে হবে’। অপরপক্ষে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে দেশের প্রতিটা সেক্টরকেও স্মার্ট করতে হবে। সব প্রকার অনিয়ম, দুর্নীতিকে প্রতিহত করতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রতিবন্ধতা ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা হল দুর্নীতির বিস্তার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, দুর্নীতি হলো একটি ক্যান্সার, যা গণতন্ত্রের প্রতি নাগরিকের বিশ্বাসকে নষ্ট করে আর উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার প্রবৃত্তিকে হ্রাস করে। ‘দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে ১৩তম বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২১ সালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ২৬, গত ৪ বছর ধরে বিদ্যমান রয়েছে। এই স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ তালিকায় নিচের দিক থেকে ১৩তম অবস্থানে আছে। যা ২০২০ সালে তুলনায় ১ ধাপ উপরে। তালিকায় ওপরের দিকে থেকে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ১৪৭তম অবস্থানে রয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় দেশটি ১ ধাপ নিচে নেমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে’। (সূত্র : ডেইলী স্টার (বাংলা), ২৫ জানুয়ারি, ২০২২)।

বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ২০২১ সালের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তৈরি করা এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) ১৪৭ নম্বরে। বাংলাদেশের এই অবস্থানকে খুবই হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি জানান, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ৮টি জরিপের ফলাফল থেকে সূচকটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছর বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে টিআই প্রতিবেদনে তালিকাভুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। পরে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার যৌথভাবে শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ১০০ স্কোরের মধ্যে এই তিনটি দেশ পেয়েছে ৮৮ করে। কম দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও সুইডেন; এই তিনটি দেশেরই স্কোর ৮৫। আর ৮৪ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ?সুইজারল্যান্ড। এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ড (স্কোর ৮২), পঞ্চম লুক্সেমবার্গ (৮১), ষষ্ঠ জার্মানি (স্কোর ৮০), সপ্তম যুক্তরাজ্য (স্কোর ৭৮) ও অষ্টম স্থানে রয়েছে হংকং (৭৬)। ৭৪ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে নবম স্থানে আছে কানাডা, আয়ারল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও অস্ট্রিয়া। যৌথভাবে দশম স্থানে আছে ৭৩ স্কোর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, জাপান ও উরুগুয়ে। টিআইর দুর্নীতির ধারণা সূচক অনূযায়ী ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তালিকার এক নম্বরে ছিল। অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়, ২০০৭ সালে সপ্তম, ২০০৮ সালে দশম, ২০০৯ সালে ১৩তম, ২০১০ সালে ১২তম, ২০১২ সালে ১৩তম, ২০১৩ সালে ১৬ তম, ২০১৪ সালে ১৪তম, ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১৬ সালে ১৫তম, ২০১৭ সালে ১৭তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ১৩তম অবস্থান লাভ করে। এই সমীক্ষা থেকে একটি জিনিস প্রতীয়মান হয়, দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান সব সময়ই উল্লেখযোগ্য অবস্থায় ছিল যা আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক। দেশে বিভিন্ন সময়ের নানান কেলেঙ্কারির কারণে দুর্নীতির সূচকের তেমন পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হয়নি। তার মধ্যে অন্যতম দুর্নীতির কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো হলো- সোনালী ব্যাংকের হল মার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাট, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপের দুর্নীতি, বহুল আলোচিত রুপপুরের বালিশ কান্ড, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ক্যাসিনোকাণ্ড, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ কাজে রডের পরিবর্তে বাঁশের ব্যবহার, গৃহহীনদের গৃহনির্মাণ কাজে দুর্নীতি ইত্যাদি। এসব আলোচিত কেলেঙ্কারিসহ জনগণের কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য দুর্নীতির কারণে আমরা আজ দুর্নীতির সূচকে গত বছরের তুলুনায় তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারিনি।

বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলা গভর্নদের উপস্থিতিতে শেষ ভাষণে বলেছিলেন- অন্য কাজ করুন বা না করুন, দুর্নীতি বন্ধ করুন। তবেই দেখবেন সমাজের সব কলুষতা কেটে গিয়ে দেশে ন্যায়বিচার, সততা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। মানুষের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন গতিধারাকে নিশ্চিত করতে হলে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ যে আমাদের সামনে খোলা নেই। প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে চলছে এদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম। সেই উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে আজ আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে, এই শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে। আমরা এ উন্নয়ন অব্যাহত রেখেই স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হচ্ছে। আমরা হয়তো কাগজে-কলমে সেই ঘোষণাও দিতে পারব। কিন্তু তখনো কিছু বিভেদ রয়ে যাবে। ধনী-গরিব বৈষম্য রয়ে যাবে। দেশে সততার সংস্কৃতি চালু করতে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা প্রয়োজন। বাঙালি কথাসর্বস্ব জাতি। আমাদের কথা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল রাখতে হবে। আমাদের নিজেদের সংশোধন হতে হবে।

দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন করার দায় শুধু সরকারের উপর দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের সচেতন ও দুর্নীতিমুক্ত রাখি, তাহলে প্রতিরোধ সহজ হবে। সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল করতে পারলেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ প্রতিবন্ধকতাহীন সহজ হয়ে যাবে।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জেলা আইনজীবী সমিতি, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত