ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আশাতীত উন্নতি করছে শ্রীলঙ্কা

রেজাউল করিম খোকন
আশাতীত উন্নতি করছে শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কা যখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলা করছিল, তখনো করোনা মহামারির ভয়ঙ্কর সময় পার করছিল গোটা বিশ্ব। তারা তাদের অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলা করতে বালাদেশের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা চেয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তখন। বিদেশি ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশ তখন শ্রীলঙ্কাকে রিজার্ভ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এই অর্থ শ্রীলঙ্কাকে তাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে সহযোগিতা করেছিল। দেশটির বড় ধরনের ঋণ সংকট কাটিয়ে উঠতে তা কাজে লেগেছিল। বাংলাদেশ ডলার ঋণ সহায়তা দিয়ে বেশ সাড়া তুলেছিল। ঋণগ্রহীতা থেকে ঋণদাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা উন্নীত হওয়ায় আমরা পুলক অনুভব করেছিলাম বৈকি। সাম্প্রতিক সময়ে সংকট মোকাবিলা করে দেশটি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করেছে। এর মধ্যে বেশ অনেকটাই তারা পরিশোধ করে ফেলেছেও। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে কিংবা যাচ্ছে- মাঝখানে খুব শোনা যাচ্ছিল। তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে নানা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখেছি আমরা। সবার মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল এ নিয়ে। সত্যি সত্যি কি বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাবে? শেষ পর্যন্ত যদিও তেমন পরিণতি হয়নি। বাংলাদেশ বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি, সমস্যা, সংকট অতিক্রম করে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় কিছুটা ঠেকাতে পেরেছে বটে; কিন্তু পুরোটা কি পেরেছে? আজ এ প্রশ্ন অনেকেরই মুখে আলোচিত হচ্ছে। চরম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিপর্যয়ে দিশেহারা, অস্থির একটি দেশের উদাহরণ হয়ে ওঠা শ্রীলঙ্কা কী অদ্ভূত জাদুবলে এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে চোখের সামনে। সে তুলনায় আমরা এখন কোথায় রয়েছি এবং কোন দিকে এগোচ্ছি? আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি এখনও সাধারণ মানুষের জীবনে চরম অস্বস্তি, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা সৃষ্টিকারী দৈত্যের মতো চেপে বসে আছে। তা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না বেশিরভাগ মানুষ। আমাদের রিজার্ভ ক্রমেই নিম্নগামী। রেমিট্যান্সও কমছে। রপ্তানি আয়েও আশাব্যাঞ্জক কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগও আসছে না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও সন্তোষজনক নয়। সব মিলিয়ে আমাদের অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল নয়। সামনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগে এক ধরনের অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে- এখনো ঠিকঠাক মতো বলতে পারছেন না কেউ। আগামী কয়েকটি মাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। তারপর বোঝা যাবে অবস্থা। এই হলো আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট পার করেছে শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর থেকে এমন সংকটে আগে পড়েনি দ্বীপরাষ্ট্রটি। কয়েক মাসের টানা লোডশেডিং ও ভয়াবহ খাদ্যসংকট, জ্বালানি ও ওষুধের সংকট সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির সরকার পতনের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সহিংস রূপ নেয়। চীনের ঋণে শ্রীলঙ্কা বেশ কটি বিতর্কিত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে, যা তাদের ঋণের বোঝা আরো বাড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দেয় দক্ষিণের হাম্বানটোটা জেলার বড় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর। এই প্রকল্প শুরুর পর থেকেই লোকসান দিয়ে আসছে দেশটি। এই সমুদ্রবন্দরের মতো চীনা প্রকল্পের লোকসানের আরো নমুনা আছে- যেমন, কলম্বোয় বিরাট কনফারেন্স সেন্টার, যা চালু হওয়ার পর থেকেই অব্যবহৃত আছে। এ ছাড়া আছে ২০ কোটি ডলার খরচে তৈরি বিমানবন্দর। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে বিমানবন্দরটি বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার মতো আয়ও করতে পারছিল না। প্রকল্পগুলো গতি পেয়েছিল রাজাপাকসে পরিবারের হাত ধরেই। পরিবারটি দুই দশক ধরে শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর পুরো দেশ যখন টালমাটাল, তখন অর্থনৈতিক স্বস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এরপর তিনি যে কাজটি করেছিলেন, তা তাদের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অনেকটা দায়ী। তিনি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর সংকোচন নীতি ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্ত বাজেট ঘাটতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায়। ট্যাক্স কাটছাঁটের কয়েক মাস পরেই বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ফলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসে, প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্সও কমে যায়। মূলত ঋণ পরিশোধের জন্য সরকার এই বড় দুই আয়ের উৎসের ওপর নির্ভর করেছিল। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন আশঙ্কাজনক হারে কমছিল, তখনই এমন এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা দেশটির জন্য আত্মঘাতী হয়ে আসে। ২০২১ সালে ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়েকটি সার ও কৃষি রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধ করে। শ্রীলঙ্কা সরকার দেশকে বিশ্বের প্রথম অরগানিক কৃষিনির্ভর দেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিশেষত অন্যতম রপ্তানি পণ্য চায়ের উৎপাদন কমে যায়। গোতাবায়া ক্ষমতা নেওয়ার ২ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ সাত দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে দুই দশমিক সাত বিলিয়ন হয়। ফলে পণ্য আমদানি করতে ব্যবসায়ীরা বিদেশি মুদ্রা জোগাড় করতে হিমশিম খান। গুঁড়া দুধ, চিনি, চাল, ডালের মতো প্রয়োজনীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেয়, গ্যাসস্টেশনে পেট্রল, কেরোসিন উধাও হয়ে যায়। তেল কিনতে মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। সঙ্গে যোগ হয় ভয়াবহ লোডশেডিং। গত বছরের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন প্রধান নিয়োগ দেন। ওই নিয়োগের পর শ্রীলঙ্কা ৫১ বিলিয়ন বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে অপারগতা ঘোষণা করে। কারণ, তারা অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখবে। কিন্তু এই পদক্ষেপ শ্রীলঙ্কার ক্ষয়িষ্ণু অর্থের ঘাটতি পূরণে ব্যর্থ হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের মূল খাত পর্যটন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে দেশটির সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের এই সময়ে দেশটির যে অবস্থা ছিল, পরিস্থিতি এখন তার চেয়ে অনেক ভালো বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত বছর চরম বিপর্যয়ের মুখে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সাত দশমিক আট শতাংশ সংকুচিত হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, এ বছরও দেশটির জিডিপি সংকুচিত হবে, তবে সংকোচনের হার কমে আসবে। আর আগামী বছর প্রবৃদ্ধি হবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিক পথেই আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যেসব শর্ত পরিপালনের কথা বলে তারা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ পেয়েছে, সেসব শর্তও তারা অন্যান্য সমগোত্রীয় দেশের তুলনায় ভালোভাবে পরিপালন করতে পারছে।

পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো করছে। সেখানে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যকার মূল পার্থক্য হলো, শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। শ্রীলঙ্কায় গত বছরের সেই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। রানিল বিক্রমাসিংহে এখন পর্যন্ত দেশকে ঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতিগত পদক্ষেপের কারণে দেশটিতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রবাসী আয় ও পর্যটনের মতো কিছু খাত একরকম ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে উন্নতি ঘটেছে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির। গত বছর জ্বালানি ও রান্নার তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে স্বল্পতা ছিল, সেটি এখন নেই। মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই কমেছে। এই সবকিছুই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অংশ। বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতি গত বছর যতটা খারাপ ছিল, এ বছর ততটা নয়। শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে আর সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে- মূলত এই দুটি নীতি পদক্ষেপের কারণে ঘুরতে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতির চাকা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশটিকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

নতুন গভর্নর আসার পর সরকার তাকে স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করার সুযোগ দেয়। মূলত যে দুটি খাতে তিনি হাত দেন তাহলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রার একক বিনিময় হার নিশ্চিত করা। অন্যান্য দেশের মতো শ্রীলঙ্কায়ও মুদ্রার অনানুষ্ঠানিক বাজার আছে, সেখানকার কারসাজির কারণেও মুদ্রার বিনিময় হারে প্রভাব পড়ে, মূল্যস্ফীতি বাড়ে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শ্রীলঙ্কায় কী করা হয়েছে? মূল্যস্ফীতির একটি কারণ ছিল দেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যাওয়া। সেটি হতো মূলত আমদানির মাধ্যমে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হতো ডলারে। ডলার বেরিয়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য কমে যায়, যে কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ২০২২ সালে দেশটির ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছেন, যাদের মধ্যে চিকিৎসক, প্যারামেডিক্যাল, তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতো অনেক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী আছেন। তারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠানোর কারণে গত ১ বছরে দেশটির প্রবাসী আয় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষেই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশ উপকৃত হয়, আবার অনেক দেশ বিপদে পড়ে। তবে শ্রীলঙ্কা এবার আইএমএফের ঋণের বেশির ভাগ শর্ত ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

যখন কোনো দেশ ভুল নীতি, অব্যবস্থাপনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অন্য বাজার যখন তাকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তখনই তারা সাধারণত আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। এসব ক্ষেত্রে আইএমএফ স্বল্প সুদে ও স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেয়। আইএমএফ কোনো বিপদগ্রস্ত দেশকে ঋণ দিয়েছে এটি জানলে সেই দেশ সম্পর্কে বাজারও আশ্বস্ত হয়।

তখন অন্যরাও এগিয়ে আসে। তবে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষেই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশ উপকৃত হয়, আবার অনেক দেশ বিপদে পড়ে। তবে শ্রীলঙ্কা এবার আইএমএফের ঋণের বেশির ভাগ শর্ত ভালোভাবেই পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আইএমএফের পরিমাণগত কর্মক্ষমতা মানদণ্ড (কিউপিসি) পূরণে দেশটি যথেষ্ট ভালো করেছে। এটি সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এই মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হলে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ থেকে আবারো অনুমোদন নিতে হয়। তখন নির্বাহী পর্ষদ যদি মনে করে যে ঋণ কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া যাবে, তাহলে বাকি অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। আইএমএফের শর্ত মেনে শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে রাজস্ব খাত সংহত করেছে। কর্তৃপক্ষ ভর্তুকি কমিয়ে এনেছে এবং করহার ও করের জাল বাড়িয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের দিকে বেশ এগিয়েছে। মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের অবস্থা তুলনীয় নয়, তবে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় কিছু তো আছে। তারা যেভাবে বড় সমস্যা মোকাবিলা করে এখন স্থিতিশীল হচ্ছে, সেটিই শিক্ষণীয় বিষয়। এ ক্ষেত্রে কী শেখা যেতে পারে? বাংলাদেশে এখনো বিদেশি মুদ্রার সংকট আছে, যার প্রভাব অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও পড়েছে। সে কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তাদের গভর্নর যেভাবে এই সংকট মোকাবিলায় নায়ক হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন, তা খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। তারা আগের নীতি থেকে সরে আসছে। কৃষি খাতে আগের ভুল নীতি থেকে সরে এসেছে। পর্যটন খাত চাঙা করা, প্রবাসী আয় বাড়ানো ও মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে তারা রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। রাতারাতি কিছু হচ্ছে না, ধীরে ধীরে হচ্ছে, সেটিই নিয়ম। তবে তারা ঠিক পথেই আছে। শ্রীলঙ্কার সব সংকট এখনো শেষ হয়নি।

তাদের ঘাড়ে এখনো বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা আছে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে অর্থনীতির চাকা আরো সচল করতে হবে। সেটি করতে গেলে আবার অর্থনীতিতে অর্থের সঞ্চার করা প্রয়োজন। তবে দেশটি এখন সবার আগে আগের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে তাদের অগ্রাধিকার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। ফলে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে খানিকটা সময় লাগবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

শ্রীলঙ্কা ঠিক পথে আছে। তবে সবকিছু নির্ভর করবে নীতি ধারাবাহিকতার ওপর; এই সরকার ও পরবর্তী সরকার এসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা কতটা রক্ষা করতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম কমতির দিকে, তখন দেশীয় বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, কিংবা বিশ্ববাজারের কাছাকাছি হারেও না কমা শুধু অস্বাভাবিক নয়, উদ্বেগজনকও বটে। দুর্ভাগ্য হলো আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা বাজার- কোনোটিই যুক্তির ধার ধারে না। সবখানে জোর-জবরদস্তি চলছে। যে যখন যেখান থেকে পারে ফাও মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছে। আর পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। সব দোষ যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এ জন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রুত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত