ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নদীভাঙন বাংলাদেশের বড় রেড এলার্ট!

কেরামত উল্লাহ বিপ্লব
নদীভাঙন বাংলাদেশের বড় রেড এলার্ট!

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা হুমকি আর উদ্বেগের সঙ্গে নদীভাঙনকে বাংলাদেশের জন্য এখন ‘লাল সংকেত’ মনে করছেন বিশ্ব সংস্থাগুলো। প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার হেক্টর জমি বিলীন হচ্ছে নদীভাঙনে। এ হিসাবে গেল ২০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে দেশের অন্তত ১ লাখ হেক্টর ভূমি।

আর্থিক হিসেব ধরলে যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। নদীভাঙন ঠেকাতেও গেল দুই দশকে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব পরিসংখ্যানেই সম্প্রতি তুলে ধরা হয়েছে এসব তথ্য। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানায়, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে শুধু পদ্মার ভাঙনেই ৬৬ হাজার হেক্টর বা ৬৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়েছে।

যার মোট এলাকার আয়তন হবে তিনটি ঢাকা শহরের সমান। নাসা তাদের প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক অভ্যন্তরীণ সর্বোচ্চ প্যানেল-আইপিসিসি বলছে- নদীভাঙনই এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঝুঁকির দুর্যোগ।

বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা তথ্যমতে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াব প্রায় ১ কোটিতে। এখন বছরে গড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ নদীভাঙনে সর্বশান্ত হচ্ছেন। এসব মানুষ জীবন-জীবিকা আর কর্মসংস্থানের জন্য গ্রাম ছেড়ে আসছেন শহরে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি- আইএফআরসিএস-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রধান বব ম্যাকরো ৮ বছর আগেই নদীভাঙনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, নদীভাঙন এ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। কিন্তু এতো বড় সমস্যাটি নিয়ে তেমন কোনো মহাপরিকল্পনাই জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে করা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্যনীয় হলো- বড় বড় নদীগুলোর ভাঙনের তীব্রতা গেল কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। ফলে বহু পাড়া-মহল্লা, ইউনিয়ন এমনকি উপজেলার মানচিত্রও পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি সীমান্তের অনেক নদীর অস্বাভাবিক ভাঙন দেশের সীমান্ত রেখা বদলে দিচ্ছে। এমন আশংকা উল্লেখ করেছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস-সিইজিআইএস। সীমান্ত এলাকায় নদীভাঙন কেনো এতো বিধংসী হচ্ছে- তাও খুঁজে বের করেছেন গবেষকরা। তারা বলছেন- বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হচ্ছে- তার প্রধান ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা। এ চারটি নদীই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার।

নদীরপাড় গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ হলো যমুনা নদী। এরপর পদ্মা। অতিরিক্ত পলি পড়ে নদীর তলদেশ ভরাট, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং শাখা-উপশাখা দখল ও ভরাটও ডেকে আনছে নদী ভাঙনের এই মহাসর্বনাশ।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের লোভও এজন্য দায়ী বলে মনে করছেন গবেষকের অনেকে।

প্রধান নদীগুলো ছাড়াও তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, মনু, জুরী, সাঙ্গু, ধলাই, গোমতী, মাতামুহুরি, মধুমতি, সন্ধ্যা, বিশখালী এসব নদীও ভাঙনপ্রবণ। এসব নদীর অন্তত দেড়শ’ স্পটে এখনো বড় ধরনের ভাঙন বিদ্যমান। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এমনিতেই বাংলাদেশে প্রতিবছরই আবাদী জমি কমছে।

বাড়ছে মানুষ। নদীভাঙা উদ্বাস্তু মানুষের চাপ পড়ছে বড় শহরগুলোতে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ কি? যদিও চাইলেও পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা করেও প্রকৃতির এতো বড় বিপর্যয় মানুষের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব নয়। তারপরও এখন সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে হবে নদীভাঙন কমিয়ে আনতে। এজন্য শুধু জাতীয় নয়, নিতে হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা, পরামর্শ ও পরিকল্পনা।

লেখক : নির্বাহী সভাপতি,

সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট

চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত