ঢাকা ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসি

নিশ্চিত করতে হবে মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা
ফার্মাসিস্ট ছাড়া ফার্মেসি

আমাদের গ্রামের একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য পেটেরব্যথায় ভুগছিলেন। গ্রামের ডাক্তার তাকে এক ধরনের ব্যথার ওষুধ দিলেন। ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের নির্দেশনা দিলেন একটি করে দিনে তিনবার সেব্য। তাকে বিকালে একটা এবং রাতে খাবারের পর আরেকটা ট্যাবলেট খাওয়ানো হলো। রাত পেরিয়ে সকাল হলো অথচ তিনি ঘুম থেকে উঠছেন না। তার সন্তানরা মনে করলেন- বাবা বোধ হয় ‘সুস্থ’ হয়ে গেছেন। তাকে আর জাগানো হলো না। অনেক বেলা হওয়ার পরও তিনি যখন নাস্তা খেতে উঠলেন না, তখন তাকে জাগোনোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোনোভাবেই তার ঘুম ভাঙছে না। চিন্তত হয়ে তার স্বজনরা আবার ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার দেখে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এটাতে ব্যথার ওষুধ নয়- এটা তো ঘুমের ওষুধ সিডাকসিন। ওষুধের দোকানের বিক্রয় কর্মী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন না হওয়ায় তিনি এমন একটি মারাত্মক ভুল ওষুধ দিয়েছেন। এমনি নানা অঘটন দেশের ফার্মেসিগুলোতে ঘটছে। ফার্মাসিস্টের পরামর্শে বিভিন্ন রোগের ওষুধ বিক্রির নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ফার্মেসি চলছে ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট ছাড়াই। দুর্বোধ্য এবং কাছাকাছি নামের মিল থাকা কিছু ওষুধ বিক্রেতাদের অনভিজ্ঞতার কারণেই ক্রেতারা কিনছেন এবং ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। ফার্মাসিস্টদের পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ মডেল ফার্মেসি ইনিশিয়েটিভ’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য ছিল ফার্মেসি এবং ফার্মাসিস্টের মানোন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের কাছে নিরাপদ ওষুধ পৌঁছে দেওয়া।

সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ব্যক্তি মালিকানাধীন খুচরা ফার্মেসিগুলোকে দুই স্তরে ভাগ করা হবে। প্রথম স্তর মডেল ফার্মেসি এবং দ্বিতীয় স্তর মডেল মেডিসিন শপ। মডেল ফার্মেসি আর মডেল মেডিসিন শপের পরিচালনার নিয়মকানুন নিয়ে একটি আদর্শ মান তৈরি করা হয়, যা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিতে অনুমোদন করে। তারপরও ফার্মেসিগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ সাধারণ ক্রেতাদের। চিকিৎসকের লেখা এক কোম্পানির ওষুধের পরিবর্তে অন্য কোম্পানির ওষুধ গছিয়ে দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধ সরবরাহ করা, সেবাপ্রার্থীকে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দোকানের জন্য লাইসেন্স নিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট হতে হয়। দেশে পর্যাপ্ত গ্র্যাজুয়েটধারী না থাকায় ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের নামে লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। ‘সি’ ক্যাটাগরি হিসেবে সার্টিফিকেটধারীদের নামেও লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। সার্টিফিকেটধারীদের মনোনীত করে থাকে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি। ফার্মেসি ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় বলা হয়েছে, সংবেদনশীল ওষুধ ফ্রিজে এবং নির্ধারিত শেলফে ওষুধ সংরক্ষণ করতে হবে। ওষুধ ছাড়া অন্যান্য পণ্য আলাদা শেলফে রাখতে হবে। ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। সেবনবিধি সম্পর্কে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। পূর্ণ কোর্সে ব্যবস্থাপত্রে নির্দেশিত নিয়মে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে পরামর্শ দিতে হবে। অথচ কোনো কোনো ফার্মেসিতে মিলে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মানুযায়ী, ফার্মাসিস্টদের ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মেসিতে, ৩০ শতাংশ হসপিটাল ফার্মেসি, ৫ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, ৫ শতাংশ সরকারি সংস্থায় ও ৫ শতাংশ একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার নিয়ম রয়েছে। অথচ দেশে কমিউনিটি কিংবা হসপিটাল ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা ফার্মেসিতে কাজ করতে আগ্রহী হন না।

চিকিৎসকরা রোগীদের ওষুধ দেওয়ার আগে সেই ওষুধগুলোকে নানা রকম যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ল্যাবরেটরিতে ওষুধের ডোজ ও বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই সেই ওষুধ চিকিৎসকরা রোগীদের দিয়ে থাকেন। এরপরেও ওষুধের নানা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলে এবং শেষে তা বাজারে ছাড়া হয় সবার ব্যবহারের জন্য। তাই চিকিৎসাক্ষেত্রে অনেক সময়ই ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা কিছুটা আড়ালে থাকলেও, সাধারণ মানুষের জন্য ওষুধ তৈরি ও বিতরণের ক্ষেত্রে ‘এ’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টরা বলছেন, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে এটাই বাস্তব চিত্র যে, অধিকাংশ রোগীর কাছে ফার্মাসিস্টই তার প্রথম পরামর্শক এবং আরোগ্য সহায়ক। ফার্মেসিতে গিয়ে অনেক রোগী প্রথম জানতে পারে তাদের ব্লাড প্রেশার বা ডায়াবেটিসের কথা, জানতে পারে প্রথম গর্ভধারণের খবর। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রোগী প্রথম যাকে কাছে পায়- তিনি ফার্মাসিস্ট। অথচ অনেক সচেতন মানুষও জানেন না- দেশে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা ও তাদের কাজের পরিধি সম্পর্কে। তাই দেশে ফার্মাসিস্টদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য শিক্ষিত যুব জনগোষ্ঠীতে ফার্মাসিস্ট পদে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তাদের মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত