ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক যদি কার্যকারিতা হারায়

অলোক আচার্য
প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক যদি কার্যকারিতা হারায়

জীবন রক্ষাকারী উপাদানের নাম হলো ওষুধ। অসুখ হলে আমরা ওষুধ খাব সেটাই স্বাভাবিক। ওষুধে যে রোগ ভালো হয় এটা যেমন আমরা জানি সেভাবে এটাও ভালোভাবে জানা উচিত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও। আজকাল রোগ সারানোর জন্য যখন-তখন যে কোনো মানুষ ব্যবহার করে অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে ২০১৯ সালে বিশ্বে ১২ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক একটি গবেষক দল ২০৪টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই ইস্যুতে আজ পর্যন্ত পরিচালিত সবচেয়ে বড় জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে ম্যালেরিয়া বা এইডসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয় তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে এই প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে। প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে দরিদ্র দেশগুলো তবে এটি সবার জন্যই হুমকি। এই সংক্রমণ মোকাবিলায় নতুন ওষুধে বিনিয়োগ এবং বর্তমান ওষুধগুলো আরো বেশি বিবেচনা করে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে প্রতিবেদনটি। গত কয়েক বছর ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে এগুলোকে অকার্যকর করে তুলেছে। তারা হিসাব করে দেখেছেন, ২০১৯ সালে ৫০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুতে এএমআর একটি ভূমিকা রেখেছে। আর সরাসরি এর কারণে মৃত্যু হয়েছে ১২ লাখের বেশি মানুষের। একই বছর এইডসে মৃত্যু হয়েছে আট লাখ ৬০ হাজার মানুষের, আর ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে ৬ লাখ ৪০ হাজার। একজন চিকিৎসক যখন তা প্রেসক্রিপশন করবে তখনই আমরা তা খেতে পারি। এসব না মেনে আমরা জেনে বা না জেনেই অ্যান্টিবায়োটিক কিনছি এবং সেবন করছি। যখন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত পরজীবীগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী হয়, খাপ খাইয়ে নেয় এবং প্রচলিত ওষুধগুলো কাজ করে না তখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের উদ্ভব ঘটে। সম্প্রতি এক তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে অন্তত ৮ শতাংশ জীবাণু সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের শীর্ষ ১০ হুমকির মধ্যে একটি হলো এএমআর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে মোট ৯০০ রোগী ভর্তি হয়েছিল। যাদের মধ্যে ৪০০ জন মারা যায়। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদেতাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ছিল। মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুপারবাগে মারা যাওয়াদের শরীরে সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলেও তা কাজে আসেনি।

অ্যান্টিবায়োটিক কি বা কখন এর প্রয়োগ করতে হয়, তা অধিকাংশ রই অজানা। আবার জানলেও তা মানার ধৈর্য নেই। আমার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন কি না সেটা না জেনেই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি। কে কখন কোন দোকান থেকে কেন কিনছে তার খোঁজ কে রাখছে? তার কোনো উপায়ও নেই। অ্যান্টিবায়োটিক হলো সেই ওষুধ যা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ধ্বংস করে। যদি এটা সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করা হয় তাহলে তা যেমন জীবাণু ধ্বংস করে অপরদিকে যদি এর বিপরীত অর্থাৎ সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করা না হয় তাহলে উল্টোটা হতে পারে। জীবাণুই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজেকে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও অ্যান্টিবায়োটিক দেয়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে দুইবার ভাবা হচ্ছে না। অথচ অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধে জাতিসংঘসহ একাধিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংস্থা একাধিকবার বিশ্বে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বিশ্বের অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্রমশই এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা নেই এবং তারা এর ক্ষতির দিক কমই জানে। এই সমস্যার কিছু উন্নত বিশ্বেও বিদ্যমান। সিডিসির এক জরিপে দেখা গেছে, সেখানে ডাক্তারদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপসনের কানের সংক্রমণের জন্য ৩০ শতাংশ, সাধারণ ঠান্ডার জন্য ১০০ শতাংশ, গলাব্যথার জন্য ৫০ শতাংশ প্রেসক্রিপশন অপ্রয়োজনীয়। এটা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনের বিষয় আসছে। এখানে তো দোকানে গেলেই মুখে বলেই ওষুধ কেনা যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ক্রেতার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করার কথা না থাকলেও তা প্রায়ই মানা হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যে জানা যায়, অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল ব্যবহার ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আমরা চাই যেন দ্রুত রোগ সেরে যায়। আর এ কারণেই উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক খেতেও দ্বিধা করছি না। অথচ অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার একটা নিয়ম আছে, একটি নির্দিষ্ট ডোজ আছে এবং মেয়াদ আছে। অর্থাৎ একজন চি,কিৎসকের পরামশের পরামর্শেই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা যায়। অনেকেই আজ অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন এবং মাঝখানে বাদও দিচ্ছেন কারণ তার রোগ ভালো হয়ে গেছে। এই যে আমরা এভাবে রোগ ভালো করার জন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি এর কারণ আমাদের অজ্ঞানতা এবং অস্থিরতা। রোগ হলেই ছুটছি অ্যান্টিবায়োটিকের দিকে এবং ধরেই নিচ্ছি এটা ছাড়া আজকাল অসুখ ভালো হয় না। এক অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না হলে সাথে সাথেই আমরা তার চেয়েও দামী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছি অথচ কোনো রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করছি না। এশীতে যা হচ্ছে তা হলো আমাদের রোগ ভালো হচ্ছে কিন্তু যে রোগ অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই সুস্থ হতো তা থেকে মুক্ত হতে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হচ্ছে। এবং আমাদের শরীর তার সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। আমরা জানিও না এর মাধমে আমরা দ্রুত একটি বিপদের মধ্যে পরছি। এভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করার ফলে আমাদের শরীর দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্সের দিকে যাচ্ছে। অবস্থা এমন যে আজ সাধারণ ঠান্ডা সর্দি জ্বর সারাতেই অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হচ্ছে।

সম্প্রতি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ইনফেকশাস ডিজিজ বা সংক্রামক রোগে ব্যবহুত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কার্যকারিতা শীর্ষক এক গবেষণার আংশিক ফলাফলে জানা যায়, মানুষের শরীরে শনাক্ত হওয়া ব্যকটেরিয়ার এমন জিন মিউটেশন (অণুজীবাংশ পরিবর্তন) হয়েছে যেগুলো বাংলাদেশে এর আগে পাওয়া যায়নি। ব্যাকটেরিয়ায় পরিবর্তিত এ জিনগুলো অ্যান্টেবায়োটিক প্রতিরোধী। এর ফলে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক এসব প্রতিরোধী ব্যাকুেদ্ধে কাজ করতে পারছে না। অথচ গত ত্রিশ বছরেও ৩০ামক রোগের নতুন মলিকুলস অব অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। শুধু জেনারেশন এক্সটেনশন হয়েছে। অথচ জীবাণুগলো এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে যা আগামী, প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর খবর। সামান্য সর্দি কাশিতেই আজকাল শিশুরা খুব বেশিখুব বেশি রোগে ভুগছে যেখানে শিশুদের শরীরে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কথা। অনেক অভিভাবক সে অপেক্ষা না করেই প্রথম দিন থেকেই কোনো ওষুধের দোকানির পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনছেন। এতে সাময়িক ভালো ফল পাওয়া গেলেও সেটা কীভাবে তার সন্তানের জন্য ক্ষতি করছে, তার ধারণা সেই অভিভাবকের নেই। হয়তো এমন একসময় আসতে পারে যখন শরীরের জীবাণুকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই আর ধ্বংস করা যাবে না। সে সময়টা হবে ভয়াবহ। এই পরিণতির জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের অসচেতনতা, আমাদের অজ্ঞানতা এবং আমাদের রোগ সম্পর্কে ভুল ধারণাই এই পরিণতির জন্য দায়ী। একটি বিষয় লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, অ্যান্টিবায়োটিক অনেক সময়ই বিক্রি কেনা-বেচা হয় কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়া। মুখে বলেই ওষুধ কিনতে দেখা যায়। এটা বন্ধ করতে হবে। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেন অ্যান্টিবায়োটিক কেউ বিক্রি করতে বা কেউ কিনতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করতে হবে।

যাতে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করে এবং বাদও না দেয় এবং নিয়ম মেনে গ্রহণ করে। কারণ এর ব্যতয় ঘটলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। একটি সুস্থ সভ্যতা গড়ে তুলতে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু সেটা অবশ্যই তখন যখন সত্যিকার অর্থেই এই প্রকারের ওষুধ শরীরের জন্য প্রয়োজন রয়েছে। আর তা সম্ভব না হলে একটি খারাপ ভবিষ্যত মানব জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত