ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অভিমত

রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে

এস এম খান
রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকেই মনোযোগ বাড়াতে হবে

কয়েক দিন আগে রাতে শ্যামলী রিং রোডের একটি মার্কেটে স্ত্রীসহ কেনাকাটা করে বাসার দিকে রওনা হয়ে শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রাস্তা (মিরপুর রোড) পার হওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। এখানে মিরপুর রোডের ওপর একটি ফুটওভার ব্রিজ ছিল, কিছুদিন আগে সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন মানুষজনের রাস্তা পার হওয়ার স্বীকৃত কোনো পন্থা নেই। রাস্তার যেসব অংশে দুই ডিভাইডারের মাঝে ফাঁক আছে, রাস্তা পার হওয়ার জন্য সেই অংশগুলোকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। বেপরোয়া গতির চলন্ত যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোভাবে রাস্তা পার হতে হচ্ছে। স্ত্রীসহ এভাবে তো রাস্তা পার হতে পারব না, তাই উপায়ান্তর না দেখে শুধু রাস্তা পার হওয়ার জন্য ২৫০ টাকায় বাসা পর্যন্ত সিএনজি অটোরিকশা নিতে হলো, যে পথটুকুর রিকশা ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। এখানে মিরপুর রাস্তার দুই পাশেই বসতি ও প্রচুর দোকানপাট আছে এবং মানুষের রাস্তার এপার-ওপার থেকে ভোগান্তির শেষ থাকে না। তাই মনে হয়, যেসব রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ, কিন্তু রাস্তার দুই পাশের এলাকায় রিকশা চলে এবং মানুষজনকে হরহামেশা এপার-ওপার হতে হয়, সেখানে অবশ্যই রিকশা পারাপারের ব্যবস্থা রাখা দরকার।

যাক মূল প্রসঙ্গে আসি। ব্যস্ত রাস্তাগুলো পার হওয়া আসলেই কঠিন কাজ। ঢাকা শহরে যানজটের কারণে এমনিতেই ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যায় না। তার মধ্যে সুযোগ পেলেই ড্রাইভারদের লাগামহীন গতি মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়। উন্নত দেশগুলোয় রাস্তায় চলা গাড়িগুলোকে দেখে ভয় লাগে না। রাজপথ কাঁপিয়ে পথচারীর বুকে কাঁপন তৈরি করে না। আর আমাদের নগরজুড়ে ঠিক এর বিপরীত চিত্র। ঢাকা শহরের প্রায় সব রাস্তার উঁচু উঁচু ডিভাইডার টপকে দ্রুতগতির যানবাহনের ফাঁক গলিয়ে এলোমেলোভাবে রাস্তা পার হতে জনগণ যেমন চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েন, ঠিক তেমনি যানবাহনের স্বাভাবিক গতিও বিঘ্নিত হয়, আর এতে করে শহরজুড়ে রাস্তাগুলোয় অরাজকতা বিরাজ করে। যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন ও মানুষজনের রাস্তা পার হওয়াকে বিপদমুক্ত রাখতে বহু আগে থেকেই ফুটওভার ব্রিজের প্রচলন হয়েছে। কিন্তু রাস্তা পারাপারে মানুষের মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে আগ্রহই নেই। অনেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে চান না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোড ডিভাইভার লাফিয়ে, যানবাহন মাড়িয়ে, গাড়ির সামনে দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে রাস্তা পার হন। অনেক মহিলা কোলে এক শিশু, হাতে আরেক শিশু এবং পিঠে স্কুল গোয়িং সন্তানের ব্যাগ চড়িয়ে রাস্তা পার হন। অনেকেই পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার জন্য ফুটওভার ব্রিজে উঠতে-নামতে পারেন না। আবার তাদের অপারগতাকে অ্যাড্রেস করতে গিয়ে সব ফুটওভার ব্রিজে লিফট লাগানো সম্ভব নয়। তাই ওই ধরনের মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে চাপ দেওয়া যাচ্ছে না। আবার ভীতি নিয়ে তাদের রাস্তা পার হওয়াকেও সমন্বয় করা হচ্ছে না। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহা সত্ত্বেও ঢাকার যে ব্রিজগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, সেগুলো ভেঙে এবং শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে আবার নতুন করে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ তৈরিতে জায়গার যেমন অপচয় হয়, ঠিক তেমনি অনেক টাকাও খরচ হয়। সঠিক মেইনটেন্যান্সের অভাবে পুরো স্থাপনাটি কদর্য আকার ধারণ করে, দিনে ফেরিওয়ালা ও রাতে ভাসমান মানুষের দখলে চলে যায়, এমনকি সেখানে অনৈতিক কার্যকলাপের কথাও শোনা যায়। আমাদের শহরগুলোয় যে আঙ্গিকে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়, তাতে শহরের বা রাস্তার সৌন্দর্যবর্ধন দূরে থাক, বরং সৌন্দর্যের হানি ঘটে। ঢাকা শহরে ফুটওভার ব্রিজের সংখ্যা ৮৯, তবে অনেকগুলোই অব্যবহৃত। তিনটি আন্ডারপাসও তৈরি হয়েছে পথচারী পারাপারের জন্য; কিন্তু এগুলোর দশা ফুটওভার ব্রিজের মতোই।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রতিদিন মগবাজার থেকে ধানমন্ডিতে যান। বাংলামোটরে এসে তাকে আবার রিকশা বদলাতে হয়, বাংলামোটর মোড়ের ফুটওভার ব্রিজে ওঠার জন্য অনেক দিন চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তড়িঘড়ি করে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাই এ ধরনের মানুষের জন্য রাস্তা পার হওয়া খুবই কঠিন একটি কাজ। রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ কি আধুনিক কোনো কনসেপ্ট? পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ ব্যস্ত কয়টা শহরে ফুটওভার ব্রিজ আছে? উন্নত দেশগুলো থেকে এগুলো অপসারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশ্বে ফুটওভার ব্রিজ তৈরির কনসেপ্টটি চালু হওয়ার সময় রাস্তায় যানবাহনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি হয়। সময় পাল্টেছে, এখন জনসাধারণ বা পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশুদের জন্য ব্যবহারবান্ধব নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত