ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সন্তানের মানসিক গঠনে অভিভাবকদের ভূমিকা

সালমা তালুকদার
সন্তানের মানসিক গঠনে অভিভাবকদের ভূমিকা

প্যারেন্টিং শব্দটি এখন অনেক বেশি চর্চা হয় সমাজে। এই বিষয়ের ওপর প্রতি বইমেলায় বই বের হয়। বাজারে খুঁজলে প্যারেন্টিংয়ের ওপর অনেক বই পাওয়া যাবে। অভিভাবকরা সন্তান লালন-পালনের বিষয়ে গাইডলাইন চান। অথচ এমনটা আশি-নব্বইর দশকে দেখা যায়নি। আমাদের মা-বাবাদের দেখেছি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের চিন্তা, কাজ-দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সংসারের দায়িত্ব পালনে তারা ভীষণ তৎপর ছিলেন। সেই দায়িত্ব পালনের মধ্যে সন্তান লালন-পালনও একটা দায়িত্ব ছিল। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে একজন মা সন্তানকে নিয়ে পড়তে বসাতেন। বাবা বাড়ি ফিরে সন্তানের কাছে সারা দিনের কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নিতেন। এছাড়া সন্তানকে সমাজ, পরিবার, নৈতিকতা বিষয়ে আলাদাভাবে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি কখনো। অথচ সেসব দিনের ছেলেমেয়েদের আদব কায়দা, নৈতিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আর অভিভাবকরাও আলাদাভাবে প্যারেন্টিং নিয়ে চিন্তা করতেন না।

বর্তমানে আমরা দেখি, শিশুর জন্মের পরে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মা-বাবা আদর-আহ্লাদে সন্তান বড় করতে থাকেন। সমস্যা হয় যখন সন্তান বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করে। এই সময়ে মা-বাবা যেন তার সন্তানকে চিনতেই পারেন না। নিজের সন্তানের আচরণিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে একেবারে হিমশিম খেয়ে ওঠেন। তখন বিভিন্নজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়ে দেখেন তারাও একই সমস্যায় ভুগছেন। হাতে এখন বিশ্ব আছে। সুতরাং খুঁজতে থাকেন ইন্টারনেটে যদি কোনো গাইডলাইন পাওয়া যায়। আর যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তারা খোঁজেন প্যারেন্টিংয়ের ওপর লেখা বই। এত খুঁজেও আদৌ কি অভিভাবকরা কোনো সমাধান পান! যদি পেয়ে থাকেন তা হলে এখনো চারিদিকে প্যারেন্টিং নিয়ে এত হাহাকার কেন! অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের মতের এত অমিল কেন! কি এমন পরিবর্তন এসেছে যে, আগের মতো আর সহজভাবে সন্তান লালন-পালন করা যাচ্ছে না। অনেক প্রশ্ন এখানে চলে আসে।

চলুন এখন বিস্তারিত আলোচনায় আসি। বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন নিয়ে যদি শুরু করি তবে প্রথমেই আমরা ছোট-বড় সবার হাতে স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কথা বলব। এই বিষয়টা আরো একটু এগিয়ে দিয়েছে মাঝে করোনাভাইরাসের আবির্ভাব এবং অনলাইন ক্লাস। নয়তো সন্তানের হাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর ও মোটামুটিভাবে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু করোনার জন্য সেটা শিথিল করতে বাধ্য হয়েছেন অভিভাবকরা। স্মার্ট ফোন যার হাতে থাকবে তার সময়টা কীভাবে দ্রুত উড়ে যাবে সে টেরও পাবে না। সে ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা অভিভাবকদেরও কিছুটা দায়ী করতে পারি। কারণ তারা নিজেরাও বেশ অনেকটা সময় মোবাইল স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটান। তাই সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ কম হয়। এদিকে সন্তান তার নিজের মতো সময় কাটাতে শিখে যায়। তা হলে প্রশ্ন আসতে পারে যে যুগে ইন্টারনেট ছাড়া প্রায় কোনো কিছুই সম্ভব নয় সে যুগে সন্তানের কাছ থেকে মোবাইল কি করে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব! এখানেই আসলে মূল কথা। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা, জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটে। এখন এসে আশির দশকের মতো করে সন্তান লালন-পালনের কথা চিন্তা করা যাবে না। আগে সামাজিক প্যারেন্টিং বলেও একটা কথা ছিল। অর্থাৎ শিশুরা সমাজ ও সমাজের মানুষের দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হতো। যেমন একটি শিশু রাস্তায় কোনো একটা নেগেটিভ আচরণ করলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে পথ চলতে থাকা অপরিচিত মানুষ নিজের ঘরের সন্তানের মতো করেই ভুল ধরিয়ে দিতেন এবং শিশু তার নিজের বাসায় যেতে যেতেই সেই নেগেটিভ আচরণ ঝেড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হতো। এছাড়া প্রতিবেশী, বাসায় আসা মেহমান সবাই কম-বেশি শিশুদের যে কোনো ভালো আচরণে প্রশংসা ও নেগেটিভ আচরণে শাসন করতেন যা সেই শিশুটির অভিভাবকের কাছে মোটেই দোষণীয় ছিল না। বরং ওই শিশু যদি সেই মেহমান, প্রতিবেশী বা অপরিচিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলত তা হলে অভিভাবকরা বলতেন তিনি তোমার গুরুজন। তাকে নিয়ে কটু কথা বলা যাবে না। এই যে শিক্ষাগুলো এলো, কিন্তু চক্রাকারে সমাজে, পরিবারে চলমান ছিল। অথচ বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মানুষ নিজের সন্তান ছাড়া অন্যের সন্তান নিয়ে কথাই বলেন না। ভুলভাল দেখলেও সেটা শুধরে দিতে আসেন না। অনেকটা এড়িয়েই যান। কারণ শিশুকে ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য গেলেই সেই শিশুর অভিভাবক সেটা ভালোভাবে নেবেন না। কেবল বাইরের লোকজনই নয়, আজকাল ঘরে যদি মা-বাবা ছাড়া অন্য স্বজনরা বেড়াতে আসেন অথবা শিশুর দাদা-দাদি, নানা-নানি যদি বাসায় থাকেন তা হলেও তারা তাদের নাতি-নাতনিকে শাসন করার অধিকার রাখেন না। কারণ এখনকার অভিভাবকরা চান একচেটিয়াভাবে সন্তান তারা নিজেরা মানুষ করবেন। এখানেই সমস্যা হয়। শিশু কেবল মা-বাবার আদর শাসন পেয়ে বড় হয়। সামাজিক ও পারিবারিক আদর শাসন থেকে এক রকমভাবে বঞ্চিতই থাকে আসলে। তাই যারা প্যারেন্টিংয়ের জন্য হন্যে হয়ে বাজারে, ইন্টারনেটে তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা যেন অবশ্যই বিষয়টা নিজেরা চিন্তা করে দেখেন যে প্যারেন্টিং খুব কঠিন কিছু নয়। শিশু তার পরিবেশে সাধারণভাবেই বড় হবে। বড়দের শ্রদ্ধা করার বিষয়টা শিশুদের বোঝাতে হবে। শিশুদের সামনে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যা থেকে শিশু মনে নেগেটিভ ধারণার উদয় হয়। তাদের সামনে যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি মা-বাবার অবশ্যই চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। কারণ আগের মতো আমাদের সন্তানেরা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গ তেমন একটা পায় না। একক পরিবারে বড় হয়। তা ছাড়া আগে যে একটা প্র্যাকটিস ছিল যে, সপ্তাহে এক দিন অথবা মাসে এক দিন কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাওয়া সেটাও কমে গেছে। কারণ ছেলেমেয়েরা এখন ব্যস্ত অনলাইনে। তাই প্যারেন্টিংয়ের কৌশলটা একটু পরিবর্তন করতে হবে। সবার আগে আমাদের অবশ্যই নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সন্তান যেন পরিবারকে আপন ভেবে সবকিছু শেয়ার করে সেই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কতক্ষণ সময় ব্যয় করছে এগুলো একটু লক্ষ্য রাখতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে যে সবার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে এটা আগেই ছেলেমেয়েদের জানিয়ে রাখতে হবে। যেন ওরা নিজের পরিবর্তনের সঙ্গে অভিভাবকদের কথাগুলো মেলাতে পারে। বর্তমানের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি অ্যাডভান্স। তাদের সুন্দরভাবে মানুষ করতে হলে অভিভাবকদের অ্যাডভান্স হতে হবে। যেকোনো বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত