ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষকের গুরুত্ব

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় শিক্ষকের গুরুত্ব

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত এবং স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম একটি ভিত্তি স্মার্ট সিটিজেন। স্মার্ট সিটিজেন তৈরিতে শিক্ষকের যোগ্যতাভিত্তিক পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও শিক্ষকের পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা হলো মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের নাম। যা অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশে উৎসাহ দেয়। অন্যভাবে বলা যায় সর্বজনীন, সহজলভ্য, বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয়ে মানবসম্পদ গড়ার অবিরত প্রচেষ্টার নাম শিক্ষা। মানবিক মূল্যবোধ-বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই দায়িত্বশীল ও নৈতিকতা গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে পারে না। শিক্ষা তখনই মানুষকে পরিপূর্ণতা করে, যখন জ্ঞানের মাধ্যমে সে নিজের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়। শিক্ষা আত্মস্থ বা উপলব্ধির বিষয়, এটি মুখস্থ করার কোনো বিষয় নয়।

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিদ্যমান অনেক পেশাই একদিন হারিয়ে যাবে বা আগের মতো জনবলের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের কর্মীরা সারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিবে। তাদের এই নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে প্রয়োজন হবে বিশ্বমানের শিক্ষকের। সেরাদের সেরারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা। কিন্তু লোভনীয় অফার আর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সেই সেরাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য পেশায়। অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকরা গবেষণা থেকে সরে প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়-দায়িত্ব ও আর্থিকভাবে লাভবান বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়।

শিক্ষকের মান ও কোয়ালিটির ব্যাপারে কোনো অবস্থাতেই অন্য পেশার মতো আপস করা যাবে না। যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক না থাকলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মানবিক মূল্যবোধ ও দায়িত্ব জ্ঞানের জায়গায় যতক্ষণ শিক্ষককে দেখা না যাবে, ততক্ষণ একটি জাতিকে উন্নত রাষ্ট্রে দাঁড় করানো সহজ হবে না। শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার দিকটি সুনিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক নিজের পেশায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পদবিন্যাস ও মর্যাদাগত সংকীর্ণ চিন্তাগুলো বিশাল এক বৈষম্য সৃষ্টি করে শিক্ষা পরিবেশে। প্রত্যেকটি শিক্ষা বিভাগে নিয়োগ পদ্ধতি যথাসময়ে হতে হবে। যার একাডেমিক সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও বিষয়ভিত্তিক, বিষয়ভিত্তিক-এর বাইরে গবেষণাসহ সব ধরনের যোগ্যতা রয়েছে, তাকে ভালো মানের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকের মানোন্নয়নে সব সময় যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ইউরোপ-আমেরিকার মতো দক্ষ মানবসম্পদের সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে থাকতে হলে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে হবে। কথায় আছে, এক সময় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণা পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ ছিল বলেই তাদের সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হতো না। যথাপোযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে।

দক্ষ শিক্ষক পারে, দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করতে। এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে সঠিক মানবসম্পদ। শিক্ষাকতা পেশার প্রতি মেধাবীদের আগ্রহ যদি হারিয়ে যায়, তাহলে শিক্ষার সাফল্য আসবে না। রাষ্ট্র যদি শিক্ষককে সেই পরিমাণ আর্থিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন, তবে আগামী প্রজন্ম একদিন স্বপ্ন দেখবে তাকে শিক্ষক হতে হবে। যে ছেলেমেয়েটি আজকে প্রশাসনের বড় ক্যাডার হতে চাইছে, সেই শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইবে। ‘শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাধীন দেশের জন্য শুভকর নয়।’

কোনো পেশা কতটুকু লাভবান হলো এই চিন্তা বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে শিক্ষকতা পেশাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কাজের প্রেরণা বা প্রণোদনা না থাকলে কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয় না। শুধু গবেষণা কর্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল কাজ করা সম্ভব। শিক্ষার সর্বস্তরে রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এই সুযোগ-সুবিধা আরো কম।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে শিক্ষককে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে যোগ্য করে গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। এই পেশার প্রতিবন্ধকতাগুলো যদি আমরা দূর করতে না পারি। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পদ্ধতিতে আমরা যুক্ত হতে না পারি। তবে আমরা ব্যর্থ হব। পঠন-পাঠন ও গবেষণাতে আশানুরূপ ফল পেতে শিক্ষকদের নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা গুণাবলী অতীব জরুরি। একজন ভালো শিক্ষক, ভালো গবেষক তার গবেষণা দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। গবেষণা কাজ গবেষককে ব্যস্ত রাখে। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মহান বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কোনোরকম গবেষণা অনুদান ছাড়াই বহুকষ্টে গবেষণা করে মানবকল্যাণে রেখে গেছেন। ২০৪১-এর উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে ভালো শিক্ষক, গবেষণা ও গবেষকদের কোনো বিকল্প নেই। একুশ শতকের প্রকৃত সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। শুধু মানুষই জ্ঞান অন্বেষণ করতে পারে, জ্ঞান ধারণ করতে পারে এবং জ্ঞান ব্যবহার করতে পারে। আর শিক্ষকরা হলো জ্ঞানের বাতিঘর। শিক্ষকের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য দেখতে সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

লেখক : শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত