ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার’

মো. তানজিমুল ইসলাম
‘বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার’

জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই সত্ত্বেও এ দেশটি যেন শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র অনেকটাই আশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশ আজ নানাভাবে সুপরিচিত। এরই মধ্যে এ দেশটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’-এর তকমা গায়ে লাগালেও মূলত : মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। অদৃশ্য কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারমূল্য মোটেই নিয়ন্ত্রণে নেই। এমতাবস্থায়, শিশুসহ পুরো জনগোষ্ঠী চরম ভোগান্তির শিকার। এ মুহূর্তে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা কেমন আছে? কোথায় আছে? সীমিত সম্পদ আর সীমাহীন দুর্ভোগকে সঙ্গী করে অনেক শিশু অবেলায় তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি টেনেছে।

ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর তথ্যমতে, করোনা-পরবর্তী পুরো দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন অনেকটাই ঝুঁকির মুখে। আজকাল আর স্কুলের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ছোট্ট বাড়িতে বা বস্তি এলাকায় কেমন কাটতে পারে তাদের দৈনন্দিন? এরই মধ্যে মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করলেও, আজ তারা নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে প্রমাণ করছে। আজকাল নতুন করে গৃহকর্মে, ইটের ভাটায়, কলকারখানায়, হোটেলে, ভ্যানে, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তাদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই।

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ, আইনের এই বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে অনিয়মতান্ত্রিক শিশুশ্রম চলছে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই। যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি। আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার আনন্দে পুলকিত; ঠিক সেই মুহূর্তে এসব শিশু তথা আগামীর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা ভাবলে কি আর ভালো থাকা যায়? বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শিশুশ্রম রোধে নানাবিধ কাজ অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না কিছুতেই। ক্রমশ: শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা যেন হারতে বসেছি। করোনার ভয়াল থাবার পরপরই অনিয়ন্ত্রিত বাজারমূল্য আমাদের অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে (তথ্যসূত্র : সময় সংবাদ ২২ জানুয়ারি ২০২২), যার মধ্যে ১৯ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যা তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক। শৈশবে যার হাতে থাকার কথা ছিল বই, খাতা আর পেন্সিল, যাদের হাত ধরে এদেশ নতুন করে এগিয়ে যাবার কথা, তারাই যেন আজ জীবিকায়নের মূল কারিগর হয়ে অভাবগ্রস্ত সংসারের সংগ্রামী সৈনিক সেজেছে। একশ্রেণির লোভী, অর্থ-পিপাসু মানুষ নামের দানবরা এই সব শিশু ও তার পরিবারের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে। কেননা, শুধু বয়সে কম অথবা শিশু হওয়ার জন্যই তাদের শ্রমের মূল্য খুবই নগণ্য হয় এ সমাজে। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই একটি মুহূর্তের জন্যও। চোখের সামনেই এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই। নির্বাক দর্শক-শ্রোতা হয়ে যেন শুধু হজম করে ফেলি সবকিছুই! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে (১) বৈষম্যহীনতা, (২) শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, (৩) শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও (৪) শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনের কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে-এর যথাযথ প্রয়োগ খুবই বিরল। মজার ব্যাপার হলো, একই ছাদের নিচে বাড়িওয়ালার শিশু-সন্তানরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে সকাল ১০টায় বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সি গৃহকর্মী নামক আরেকটি শিশুকে তখন কাকভোরে উঠে রুটিন মাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়। নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনোদিন কোনো বাড়তি প্রশংসা না জোটে না। অথচ, একদিন ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলেই পুরস্কার হিসেবে জোটে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আর এসবের সাক্ষী হয় তাদেরই সমবয়সি আলালের ঘরে দুলালরা। তবে শিশু অধিকার সনদ কি শুধুই ওই অভিজাত শ্রেণির বিশেষ শিশুদের জন্যই? এই শিশু অধিকার সনদ কি তাহলে সার্বজনীন নয়? শিশুশ্রম শুধু একটি শিশু বা তার পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তার সব সম্ভাবনা। নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকে যারা গলাটিপে হত্যা করে বা যারা প্ররোচিত হতেও বাধ্য করে তারা আসলে কেমন মানুষ। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো- সুশিক্ষা (প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক)। তবে অনুকূল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে, তখন শৈশবেই তাকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় এ দেশে। কাজ যতই হোক, পারিশ্রমিকের বেলায় (অল্প টাকায়) শুধু শৈশবকে বিবেচনা করা হয় এ সমাজে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। আর এখনি তার প্রকৃত সময়। সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি, সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশে নতুন করে দরিদ্রের হার বাড়ছে। এর ফলে শিশুশ্রমের ওপর এক ব্যপক প্রভাব পড়েছে। শিশুশ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি নাড়া দেয়। সত্যিই তাই! বাস্তবতা হলো : সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অনেক বড় ভূমিকা নিতে হবে। সুন্দর আগামীর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি প্রয়োজন, প্রতিটি শিশুর জন্য আমজনতার আন্তরিক ভালোবাসা। নয়তো, এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তিসহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! রাগ-ক্ষোভণ্ডঅভিমানে এদেশের মানচিত্রকেও হয়তো তারা চিবিয়ে খেতে চাইবে একদিন! বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই যেখানে শিশু (৬ কোটি ৬০ লাখ), সেখানে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করা কতটা জরুরি তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত