ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশু অধিকার সুরক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি প্রয়োজন

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস
শিশু অধিকার সুরক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি প্রয়োজন

আমাদের সমাজে এখনও শিশুরা বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, বিভিন্ন যানবাহনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অথচ কোমলমতি এসব শিশুদের এ সময়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত এবং অন্নবস্ত্র, বাসস্থান, সুচিকিৎসার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের গন্ডিতে সহপাঠীদের সঙ্গে শৈশব উপভোগে খেলাধুলায় মত্য থাকার কথা। কখনও কি আমরা ভেবেছি, এই শিশুরা পড়ালেখা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তা না পেয়ে কীভাবে বেড়ে উঠছে? কিন্তু শিশুদের এসব অধিকার নিশ্চিত করা দূরে থাক, আমাদের এ নিষ্ঠুর সমাজে তাদের প্রকাশ্যে পিটিয়ে, ছেঁকা দিয়ে, এমনকি নিভৃত ঘরে বন্দি করে রেখে দানা-পানি না দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটছে, আমাদের দেশসহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশে। এমন অবহেলা সামাজিকভাবে কত বড় লজ্জাজনক তা ভাবলে শিউরে ওঠা ব্যতীত কোনো করণীয় থাকে না অনেকেরই। কিন্তু এমন পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করা খুব জরুরি। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তাদের অংশগ্রহণ জরুরি। তাদের সুরক্ষায় বিবেচনায় জাতীয় বরাদ্দ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণার বহু আগে ১৯৭৪ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ শিশু আইন প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকার জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। পথশিশু, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।

শিশুদের মানবাধিকার এবং সব শিশুর জন্য যেসব অধিকার অর্জন করতে হলে সব দেশের সরকারকে যে নিরিখগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে, সেগুলো খুব সংক্ষেপে অথচ সম্পূর্ণভাবে বিবৃত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে : এটি হচ্ছে শিশু অধিকার সনদ। এ সনদ ইতিহাসের সবচেয়ে সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল। তাই এ দলিল মানবাধিকারের সর্বজনীন প্রয়োগ অন্বেষায় অনন্যভাবে শিশুদের মধ্যমণি করে তুলেছে। দলিলটি অনুমোদনের মাধ্যমে জাতীয় সরকারগুলো শিশুদের অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে এবং এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেদের দায়বদ্ধ করে তুলেছে।

কিন্তু তবুও আমাদের এই উন্নয়নশীল বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি যেখানে শিশু। আমাদের দায়বদ্ধতা সার্বিকভাবে এবং সামাজিকভাবে অপরিসীম। কারণ এ ৪০ শতাংশ শিশুর মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি দরিদ্র সীমারেখার নিচে বসবাস করে। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। আমরা যখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলি, তখন এই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো রকম টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও মাদককে চিরতরে বিতাড়িত করতে হবো। যৌন হয়রানি ও অশিক্ষাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অভিভাবকের সচেতনতা শিশু অধিকার রক্ষার পূর্বশর্ত। শিশু অধিকার একটি বহুমুখী ধারণা। যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও অধিকার লংঘন থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি অপরিহার্য সামাজিক কর্তব্য। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দরিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করায় আমাদের শিশুদের একটি বিশাল সংখ্যা বেড়ে উঠছে দরিদ্র্যের ভেতর। এ শিশুরা অধিকার ও প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মা ও শিশু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মায়ের অধিকার সুরক্ষা হলে, শিশুর অধিকার অনেকাংশে রক্ষা পায়।

একজন গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থায় তার অধিকারগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে পেলে, জন্মের আগে থেকেই অনাগত শিশু ও তার অধিকার ও সুরক্ষা পেয়ে যায়। তাই শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষায় সবার আগে পরিবারটিকেই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিপর্যায়ে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নিরাপত্তা, বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ রাষ্ট্র স্বীকৃত সব অধিকার এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সেগুলো হতে হবে বৈষম্যহীন। অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, লিঙ্গ, গোত্র, শারীরিক কোনো শ্রেণিভেদে শিশুদের বিভাজন করা যাবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত