ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন

বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকট

দেলোয়ার জাহিদ
বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে সুপেয় পানির সংকট

বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবের শিকার একটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, যে দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার সমগ্র অঞ্চল ও অধিবাসীগণ সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ও দক্ষতা বৃদ্ধিসহ কর্মসংস্থানের যুগপোযুগী এবং কৌশলগত পরিকল্পনার অভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে সাগরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং সংযুক্ত নদনদীগুলো দূষিত পানি প্রবাহ সাগরে ঠেলে দিচ্ছে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া বাংলাদেশে এখন প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ। আনুমানিক ৭৫ মিলিয়ন মানুষ আর্সেনিকযুক্ত জলের সংস্পর্শে এসেছে ও আরো আসতে শুরু করেছে।

এ ধরনের বিষক্রিয়া ভবিষ্যতে প্রায় ৩ লাখ মানুষের ক্যান্সার-সম্পর্কিত রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সাগর উপকূলগুলোতে লবণাক্ত পানি এলাকায় উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর পানির অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে, মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

তাই বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানির ন্যায্য সর্বজনীন ও টেকসই প্রবেশগম্যতাকে নিশ্চিত করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সরকারি বরাদ্দ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ, এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল ও জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় ও ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, সরকারি খাসজমিগুলোতে মিঠাপানির আধার তৈরি করা যেতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে প্রচুর পানির উৎস রয়েছে, তবে এ উৎসগুলো ক্রমাগত দূষিত হচ্ছে এবং পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। এমন কি ভূপৃষ্ঠের পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানির উৎস উভয়ই নানাভাবে দূষিত ও বিষাক্ত ট্রেস ধাতু, কলিফর্মের পাশাপাশি অন্যান্য জৈব ও অজৈব দূষক দ্বারা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দূষিত হয়ে চলেছে। যেহেতু বেশিরভাগ জনসংখ্যা এ জলের উৎসগুলো ব্যবহার করে, বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ জলের উৎস যা সারা দেশে উচ্চ পরিমাণে আর্সেনিক ধারণ করে; জল খাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। পানিবাহিত রোগে মৃত্যুর সংখ্যাধিক্য বাংলাদেশে ব্যাপক। গার্হস্থ্য বর্জ্যরে অনুপযুক্ত নিষ্পত্তি, অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য, কৃষিপ্রবাহ জলদূষণের ক্ষেত্রে প্রধান অবদানকারী। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য এ দেশের মোট জল দূষণের অবস্থা, সেই সঙ্গে এই গুরুতর অবস্থা উৎসগুলো অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে জলদূষণের অবস্থা এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাবের নানা চিত্র মিডিয়ায় উঠে আসছে। কানাডার আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা স্টেপ টু হিউম্যানিটি অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের কোস্টাল ১৯ গ্রুপের সহযোগে ও স্থানীয় কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স ভেলু চেইন গ্রুপের অংশগ্রহণে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। পানির অধিকার মানবাধিকার এ স্লোগান নিয়ে উপকূলীয় সকল মানুষের পানি অধিকার নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান আইএসডিই বাংলাদেশ, পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রাণ এবং একশন এইড বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি সংগঠন। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের ২৩০ কোটি লোক আজ পানি সংকটে ভুগছে। ২০২০ সালে ২০০ কোটি লোকের খাবার পানির সংকট ছিল, ৩৬০ কোটি লোকের বাড়িতে কোনো টয়লেট ছিল না এবং ২৩০ কোটি লোকের বাড়িতে হাত ধোয়ারও ব্যবস্থা ছিল না। ...স্যানিটারি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে লোকজন অতি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।... এসব পরিপ্রেক্ষিত ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ দূরের বিষয়। এ লক্ষ্যমাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পানি ও স্যানিটেশান সুবিধা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। বৈশ্বিক পানি সংকট নিয়ে জাতিসংঘের এ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কীভাবে মোকাবিলা করছে উন্নত বিশ্ব? এখানে কানাডার কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। কানাডার প্রদেশগুলোর মধ্যে জলের অধিকার পরিবর্তিত হয়। প্রতিটি প্রদেশ পানির অধিকারের জন্য নিম্নলিখিত চারটি পদ্ধতির মধ্যে একটির মধ্যে পড়ে : পূর্ব বরাদ্দ, পাবলিক অথরিটি, রিপারিয়ান রাইটস, বা সিভিল কোড। আদিবাসী জল অধিকার প্রতিটি প্রদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কানাডার বিশুদ্ধ জলের অ্যাক্সেস ছিল ২০২০ সালে ৯৯.০ শতাংশ, ২০১৯ থেকে ০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে। অনুরূপ কয়েকটি দেশের র‌্যাঙ্কিং-এ দেখা যায় মোনাকো ১০০,০০ শতাংশ, জার্মানি ৯৯.৯৯ শতাংশ এবং ম্যাকাও ৯৯.৯৮ শতাংশ পানিকে মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে, জাতিসংঘের প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিটি সরকার যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার সব নাগরিক নিরাপদ, পর্যাপ্ত, অ্যাক্সেসযোগ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পানির সঙ্গে নিরাপদ স্যানিটেশন সরবরাহ করে। একজন ব্যক্তির পানির অধিকারকে সরকার অবশ্যই সম্মান, সুরক্ষা এবং পূরণ করতে হবে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজন পানি এবং ভারতের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবন ও মানবাধিকারের অধিকার অংশ.... এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং টেকসই উন্নয়নের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার ‘জীবনের’ অধিকারের অন্তর্গত। বাংলাদেশের উপকূলের সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিতে অ্যাকশন এজেন্ডা তৈরি করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট লোকজন সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে. জাতীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জলবায়ু অর্থায়নে সহজ এবং দ্রুত প্রবেশাধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে জলবায়ু কূটনীতিকে আরো শক্তিশালী ও জোরদার করতে হবে।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত