ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি

বিশ্বে আত্মহত্যা করার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আত্মহত্যার প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিক সমস্যা সাধারণত যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আত্মহত্যা করার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারি সুপরিকল্পিত নীতিমালা চিকিৎসা স্বাস্থ্যকর্মী কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। যার ফলে দেশের মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সচেতন করা হয়। শরীর এবং মন এ দুই নিয়ে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি মনবিহীন মানুষও অসম্ভব। সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে গেলে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ মন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করছে যেটা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। দেহ আর মন মিলেই মানুষ। যার একটি অসুস্থ হলে মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বর্তমানে শারীরিক চিকিৎসার ব্যাপ্তি বাড়লেও মানসিক চিকিৎসায় বিশ্বজুড়েই রয়ে গেছে সংকট। অথচ মানসিক রোগ বসে থাকেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। যার প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতায়। বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মডেল সার্ভের তথ্যমতে, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। মানসিক অসুস্থতা কথাটি শুনলে বাংলাদেশের মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ ঘৃণায় মুখ বাঁকায়, কেউ অবজ্ঞায় নাক সিটকায়, আবার কেউবা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মানসিক অসুস্থতা সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে তীব্র লজ্জা আর আতঙ্কের একটি ব্যাপার। কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলো মানে সে যেন বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেললো যার কলঙ্ক তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং আঁতকে ওঠার মতো। এখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের ‘পাগল’ মনে করা হয়। কিন্তু কেন? কী দোষ তাদের? তাদের দোষ একটাই। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ অসুস্থতার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ জ্বর, সর্দি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড বা ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ। সমস্যা হলো, এদেশের মানুষ মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলেই মনে করে না। তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের রোগীও মনে করে না যে তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে। আর গত সাড়ে ৩ বছরে করোনায় দেশে আত্মহত্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারায়। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যায় মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মত ডব্লিউএইচওর। দেশে প্রতি বছর ঠিক কত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ১১ হাজারের মতো মানুষ আত্মহত্যা করেছে। করোনাকালে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। আর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনাকালে গেল এক বছরে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ২ জনেরও কম। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই সংখ্যা ৬০ জনেরও বেশি। তবে আশার কথা হলো, বিশ্বজুড়ে গড়ে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। পৃথিবীর স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক ১ ভাগ ব্যয় হয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়। এ কারণেই এই খাতের সন্তোষজনক অগ্রগতি তেমন দেখা যায় না। বিশ্বে শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের বাস নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। একইভাবে যাদের মানসিক রোগ আছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক এসব দেশের বাসিন্দা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্ণতা ব্যাপক আকার নেবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের বেশি) মানুষের মধ্যে ১৮ শতাংশের বেশি কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর (৭-১৭ বয়সি) মধ্যে মানসিক রোগ শনাক্ত করা গেছে। দেশে নারীদের মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে মানসিক রোগ নিয়ে বেশি সংস্কার ও নেতিবাচক ধারণা দেখা যায়। এমনকি সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসার হার ২ শতাংশেরও কম। এছাড়া প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রায় ৮০ লাখ মৃত্যু (১৪.৩ শতাংশ) মানসিক সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্বজুড়ে ৯৭ কোটি মানুষ মানসিক অসুস্থতা বা মাদক ব্যবহারজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে আগ্রাধিকার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পাবনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রচেষ্টায় দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পাবনা মানসিক হাসপাতালকে বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের নজরদারি অতীতের চেয়ে বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত