ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

রায়হান আহমেদ তপাদার
আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংকট ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার উত্তেজনা দক্ষিণ ককেশাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির হুমকি সৃষ্টি করেছে। ঘটনাক্রমে ইরান এই আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি না, সেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, ইরান কি প্রকৃতপক্ষেই আর্মেনিয়াকে রক্ষা করতে গিয়ে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজানে আগ্রাসন চালাবে? সম্প্রতি তেহরানের দিক থেকে যে সামরিক তৎপরতা, সেটা কি আরো আনেক দূর গড়াবে?

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আজারবাইজানের ভূখণ্ড নাগারনো-কারাবাখ। তা সত্ত্বেও আর্মেনিয়া সেই অঞ্চলটি তিন দশকের বেশি সময় ধরে দখল করে আছে। সম্প্রতি আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী নাগারনো-কারাবাখের অংশবিশেষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আজারবাইজান অভিযোগ করেছে, ইরান তাদের উত্তর-পশ্চিমের সীমান্তের নাখচিভান ছিটমহলে সেনা সমাবেশ করেছে। সাম্প্রতি ছড়িয়েপড়া এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও দক্ষিণ ককেশাসের যুদ্ধ পরিস্থিতি প্রশমন করা সম্ভব এবং এ ক্ষেত্রে ইরানের হিসাব-নিকাশ যতটা কৌশলের, তার চেয়ে কৌশলগত। দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে রক্তারক্তির জাতিগত বিভেদের জন্ম দিয়েছে। বিভেদকে অবলম্বন করে উপনিবেশোত্তর ক্ষমতা কাঠামোয় নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে ব্রিটিশরা যেভাবে কাশ্মীর, সাইপ্রাস, মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দি সমস্যার সমাধান করেনি, একইভাবে বৃহৎ অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়া, চেচনিয়া এবং পূর্ব ককেশাসের নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলের মীমাংসা করেনি। এই অমীমাংসার দরুন আজও দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে। নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধকে লিবিয়া, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। কারণ এই অশেষ সংঘর্ষে ফ্রান্স, তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়েছে। গত ত্রিশ বছরে তৃতীয়বার ও তিন বছরে দ্বিতীয়বার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল ঘিরে আজারবাইজান ও জাতিগত আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাত ঠেকাতে ব্যর্থ হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সর্বসাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর। আজারবাইজান বাহিনী ছিটমহল পুনর্দখলে বড় অভিযান শুরু করে এবং দ্রুততার সঙ্গে অভিযান শেষ করে। আজারবাইজান ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বঘোষিত নাগোরনো-কারাবাখ রিপাবলিকের (এনকেআর) নেতারা অস্ত্র সংবরণ করেন। তিন দিন পর আজারবাইজানের বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের অনেক গ্রাম, খনি এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাতিগত আর্মেনিয়ানদের চারপাশ ঘিরে অবস্থান নেয়। এনকেআর তাদের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করতে সম্মত হয়। এবারের সংঘাত মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতে অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। গণবাস্তুচ্যুতি এবং বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে অস্থিরতা উসকে দিতে পারে। বলা চলে, আরেকটি বড় মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। নাগোরনো-কারাবাখ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ান বাস করেন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, এই লোকদের তিনি আজারবাইজানের সমাজের সঙ্গে একীভূত করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কয়েক দশকের সংঘাত ও নৃশংসতার পর দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটা শূন্য এবং শত্রুতার মাত্রাটা অনেক বেশি। নাগোরনো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ানরা এরই মধ্যে দলে দলে আর্মেনিয়া যেতে শুরু করেছেন। এনকেআরের নেতারা বলছেন, অস্থিতিশীল অঞ্চল ছেড়ে প্রায় সব আর্মেনিয়ান তাদের জন্মভূমিতে চলে যাবেন। এই গণবাস্তুচ্যুতি পুরো অঞ্চলকে আরো অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় করে তুলবে। এই গভীর সংকটের পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের নিষ্ক্রিয়তা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) আওতায় আর্মেনিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার কথা রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। এ কারণেই নাগোরনো-কারাবাখ আর্মেনিয়ানদের স্বার্থরক্ষায় তাদের অনেক কিছু করা উচিত। কিন্তু প্রতিবার সংঘাতের পর সিনেমার কায়দায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করা ছাড়া আর কিছুই করে না মস্কো। রাশিয়া কখনোই আজারবাইজানের শত্রু হতে চায় না। সে কারণে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উত্তেজনায় হস্তক্ষেপ করতে তারা উৎসাহী নয়। এ কারণেই রাশিয়া আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে আজারবাইজানের হামলা বন্ধে আর্মেনিয়ার অনুরোধ কানে তোলে না। এমনকি সর্বশেষ হামলায় রাশিয়ার পাঁচজন শান্তিরক্ষী মারা যাওয়ার পরও তারা নিশ্চুপ। ওই অঞ্চলের সংঘাত নিয়ে রাশিয়া একমাত্র চোখ বন্ধ করে রেখেছে, তা নয়; সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করার অঙ্গীকার দেওয়া সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র তিন দশক ধরে চলা রক্তপাত বন্ধে এবং সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখায়নি। ১৯৯৪ সালে প্রথম নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনিয়ান বাহিনী ছিটমহলের চার পাশের আজেরি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আজেরি জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। সে সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজারবাইজানের সঙ্গে আলোচনায় বসার এবং দুই পক্ষের জন্য একটি টেকসই শান্তিচুক্তি করার জন্য আর্মেনিয়াকে কোনো চাপ দেয়নি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বদলে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র চোখ বন্ধ করে রাখে। তারা উল্টো আজারবাইজানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে মুনাফা করে।

আজারবাইজানে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে ইসরাইল ও তুরস্কও লাভবান হয়। আর রাশিয়া আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান দুইপক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে। ২০২০ সালের যুদ্ধে আজারবাইজান জিতে যায়। এ সময়ও বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো চুপ করে বসে থাকে। দর-কষাকষি, কথাবার্তা, বিবৃতি সবকিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু সহিংসতা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ২০২২ সালে আজারবাইজানের সেনারা আর্মেনিয়ার সঙ্গে নাগোরনো-কারাবাখের যোগাযোগের পথ লাচিন করিডোরে অবরোধ করেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা আরো স্পষ্ট হয়। এই অবরোধ চলে ২৫০ দিন ধরে। এ সময়ে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রেডক্রসকেও সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো অর্থপূর্ণ উদ্যোগ দেখা যায়নি। রাশিয়ার দিক থেকে দেওয়া সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি যে ছদ্ম, সেই ধারণা আর্মেনিয়ানদের কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আজারবাইজানের জ্বালানি খাতে বেশিরভাগ বিনিয়োগ আসে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এ কারণে পশ্চিমাদের খুশি রাখার যথেষ্ট কারণ আছে তাদের। জ্বালানি তেল বিক্রি কমে যাওয়ায় পশ্চিমা বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি বাড়িয়ে রাজস্ব ঠিক রাখতে চায় আজারবাইজান। পশ্চিমাদের অনেকে এখনো আর্মেনিয়াকে রাশিয়ার অনুগত জোট বলে মনে করে। কিন্তু গত মাসের শুরুতে যে দেশটি আমেরিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে, সেই দেশকে পরিপূর্ণভাবে রাশিয়ার মিত্র তকমা দেওয়া কতটা ঠিক। নাগোরনো-কারাবাখের ১ লাখ ২০ হাজার মানুষকে যদি পুরোপুরি বাস্তুচ্যুত করা হয়, তাহলে ১৯৯০-এর দশকের মানবিক সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সেবার আজেরি, এবার আর্মেনিয়ানরা। এই সংকট আর্মেনিয়ার গণতন্ত্রের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। আজারবাইজানের নাগোরনো-কারাবাখ বিজয় আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের জনসমর্থন কমাবে। ২০১৮ সালে গণতন্ত্রপন্থিদের অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসা পাশিনিয়ানের গ্রহণযোগ্যতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে সামরিক অভিজাতেরা আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করে ফেলতে পারে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ তার বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখলে নিচ্ছে। এছাড়া আজারবাইজান তাদের ছিটমহল নাখছিভানের জন্য ‘স্থল করিডোর’ তৈরির পথ খুঁজছে। এটি দুই দেশের মধ্যে জটিলতা আরো বাড়াবে। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সংঘাতে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের যে পদক্ষেপ, তাতে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। তাদের ব্যর্থতার কারণেই সেখানে তিনবার যুদ্ধ ও রক্তপাত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেন, ইরানসহ বিদেশে বসবাসরত আজারবাইজানিদের অধিকার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা কিছু করা দরকার, তাই করবে আজারবাইজান। তার এই বিবৃতি ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি বার্তা। অন্যদিকে ইরান তাদের দিক থেকে শিয়াদের আজারবাইজানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হচ্ছে। কেননা আজারবাইজান মাঝেমধ্যেই শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ঘাত পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করছে। যা হোক, এই প্রেক্ষাপটে ইরান যদি আজারবাইজানের ওপর কোনো হামলা করে বসে, তাহলে এমন একটা দেশের সঙ্গে তারা খোলাখুলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে যে দেশটি শুধু ইসরাইল নয়, ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কেরও শক্ত সমর্থন পায়। এ কারণেই তেহরানের নীতিনির্ধারকদের দক্ষিণ ককেশাসে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আদতে এই যুদ্ধের প্রধান দুই পক্ষ ফ্রান্স ও তুরস্ক। বর্তমান বিশ্বের প্রধান তিনটি গোলযোগ; সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে বিবাদ এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের তুরস্কের সীমানাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে যেখানে মার্কিনদের সঙ্গে ফ্রান্সও তুরস্কের প্রধান প্রতিপক্ষ। সীমান্তের তিন দিকে যুদ্ধ পরিচালনা এবং ফ্যাকাশে অর্থনীতি নিয়ে মাঠে সবল থাকা আঙ্কারার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নাও হতে পারে, তবে আঙ্কারার একমাত্র সম্বল আত্মবিশ্বাস আর ইতিহাস। অন্যদিকে ফরাসিরা সবদিক থেকেই এগিয়ে। তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা মনে করছেন, ২০২৩ সালে লোজান চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিমারা আরেকটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায় তুরস্কের ওপর। সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে সৃষ্ট বিবাদের পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার এই সংঘর্ষ আগত যুদ্ধের সম্ভাব্য ইশারা বলে ইঙ্গিত করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত