মেট্রোরেল : সহজেই বদলে দিয়েছে ঢাকা

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকায় দিনের পর দিন গণপরিবহণ বৃদ্ধির কারণে যানজটে পড়ছে নগরবাসী। এতে তাদের ভোগান্তি বাড়ছে; স্বল্প দূরত্বের জায়গায় যেতেও সীমাহীন দুর্ভোগ এবং সময়ের অপচয় হচ্ছে।

যানজটের কারণে অর্থনীতিরও একটি বড় ক্ষতি হচ্ছে। হঠাৎ মেট্রোরেলের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সবকিছু যেন বদলে গেল। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল ঢাকা শহরকে রীতিমতো পাল্টে দিয়েছে। এটি যদি মতিঝিল পর্যন্ত চালু হয়, তবে ঢাকাবাসীর বছরে প্রায় ২৫ লাখ কর্মঘণ্টা বাঁচবে। যেন সময়ের ডানা মেলা পাখি; দীর্ঘদিনের খাঁচায় বন্দি এবার মুক্ত বিহঙ্গ! সেই ডানায় ভর দিয়ে ছুটে চলবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

গবেষণা বলছে, রাজধানীতে পথে যানজটের কবলে প্রতিবছর গড়ে ৩৬ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও চালু হওয়াতে সেখান থেকে প্রায় চার লাখ কর্মঘণ্টা বাদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মতিঝিলে গেলে মিরপুর সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, আর প্রগতি সরণিতে চাপ কমবে। মেট্রোরেল আগামী এক বছরে নতুন রূপ দেবে ঢাকাকে।

মেট্রোরেল হচ্ছে একটি দ্রুতগামী গণপরিবহণ ব্যবস্থা। ২০১৩ সালে জনবহুল ঢাকার যানবাহন সমস্যা ও দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এর অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মেট্রোরেল হচ্ছে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) একটি সরকারি প্রকল্প। এটি পরিচালনা করছে ‘ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড’ (ডিএমটিসিএল)। ২০১৬ সালে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ডিএমটিসিএল এবং জাইকা ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মোট ৬টি মেট্রোলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই নেটওয়ার্কে ৫১টি উড়াল স্টেশন এবং ৫৩টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গড় গতি ছিল প্রায় ২১ (২১ দশমিক ২ কিমি./ঘণ্টা)। কিন্তু ২০১৫ সালে তা ৬-এ (৬ দশমিক ৮ কিমি./ঘণ্টা) নেমে আসে। এর ফলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার বেশি। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। তাছাড়া ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে। একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা এবং ভিড়ে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। অথচ মেট্রোরেলে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতিবছর ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান। তাছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। ঢাকাবাসীর যাতায়াতের একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হচ্ছে মেট্রোরেল।

এটি প্রচুর যাত্রী বহন করতে পারে। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বহন করে এবং প্রতি চার মিনিটে প্রতিটি স্টেশনে একটি ট্রেন যাতায়াত করে। আমরা প্রায়ই দেখি, গণপরিবহণে নারীরা প্রায়ই হয়রানির সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে রয়েছে শারীরিক বা মৌখিক হয়রানি, আসনের স্বল্পতা, নিরাপদে বাসে ওঠাণ্ডনামা ইত্যাদি।

সুতরাং তারা মেট্রোরেলে ভ্রমণে আরো আগ্রহী হবে। ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। মেট্রোরেল আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি নতুন যুগে আবদ্ধ করবে। একটি জরিপে দেখা যায়, প্রতিদিন মেট্রোরেল পরিচালনা করতে প্রায় ২ দশমিক ৩৩ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সুতরাং প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার জন যাত্রী মেট্রোরেল ভ্রমণ করলে এ টাকা উঠে আসবে। মেট্রোরেল ঢাকা শহর থেকে জনসংখ্যার ঘনত্ব সহজেই কমিয়ে আনবে। মানুষ বাসা ভাড়া কমিয়ে শহরের বাইরে থাকতে পারবে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজেই ঢাকায় আসতে পারবে।

মেট্রোরেল বিশ্বের অনেক বড় শহরে গণপরিবহণের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম দ্রুত ট্রানজিট সিস্টেম চালু করা হয়েছিল, যা এখন ‘লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর একটি অংশ। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এনওয়াইতে তার প্রথম দ্রুত ট্রানজিট রেলব্যবস্থা চালু করে। ১৯০৪ সালে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়ে প্রথমবারের জন্য খোলা হয়।

এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে জাপান হলো প্রথম দেশ, যা ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় তার মেট্রোসিস্টেম নির্মাণ শুরু করে। এরপর ভারত অন্যান্য শহরেও মেট্রোরেল ব্যবস্থা তৈরি করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে। ঢাকায় ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ উদ্বোধনের পরদিন (২৯ ডিসেম্বর) থেকে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়।

সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে মেট্রোরেল। গড়ে দৈনিক ৬৫ থেকে ৭০ হাজার যাত্রী চলাচল করে এ পথে। জানা যায়, টিকিট বিক্রিতে আয় হয় গড়ে প্রতিদিন ২৫ লাখ টাকা। মতিঝিল পর্যন্ত চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখ যাত্রী পরিবহনণ করতে পারবে; কমলাপুর পর্যন্ত চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ৬ লাখ যাত্রী পরিবহণ করবে এই মেট্রোরেল।

ঢাকার রাস্তায় সব যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা পরিবেশ দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় রয়েছে ঢাকা। মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র। যেহেতু মেট্রোরেল বিদ্যুৎচালিত এবং প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহণের মাধ্যমে যাতায়াতের প্রবণতা কমে যাবে। ইউএনবির মতে, কর্তৃপক্ষ স্টেশনগুলোর কাছাকাছি কয়েকটি ‘ট্রানজিট-ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’ (টিওডি) হাব নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। যার মধ্যে একটি বিশ্বমানের বিনোদন পার্ক, হোটেল, দৈনন্দিন পণ্যের বাজার এবং শপিং মল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। উত্তরায় প্রথম ‘টিওডি’ হাব নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেল হচ্ছে একটি স্বপ্নের প্রকল্প। মেট্রোরেল সহজেই ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক শহরে রূপান্তর করবে। আমরাও ছুটে চলব সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।