তামাক কোম্পানির পণ্য প্রদর্শনীতে কূটকৌশল নিষিদ্ধ চাই

রোকেয়া ইসলাম

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনকে (২০০৫ সালে প্রণীত, ২০১৩ সালে সংশোধিত) শক্তিশালী এবং সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি খসড়া প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছে। তাদের এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ এই খসড়া প্রস্তাবনা একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের রক্ষা করতে সহায়ক হবে এবং তামাক কোম্পানির কূটকৌশল বন্ধ করতে সক্ষম হবে।

বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনী নিষিদ্ধ থাকলেও বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্যের প্রদর্শনী বা মূল্য তালিকা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি। আইনের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো শিশু, কিশোর ও তরুণদের ধূমপানে প্রলুব্ধ করার জন্য খুবই চতুরতার সঙ্গে বিজ্ঞাপন প্রচার কূটকৌশল অবলম্বন করে। এই কূটকৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে শিশু-কিশোরদের প্রিয় খাবার যেমন, ক্যান্ডি, চকলেট, বিস্কুট প্রভৃতির পাশে বা দৃষ্টি বরাবর তামাকজাত পণ্যের প্যাকেট প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া ওই বিক্রয় কেন্দ্রগুলোর বসার স্থানের পাশেই খুচরা মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হয় যা এক প্রকার বিজ্ঞাপনেরই নামান্তর।

তামাক কোম্পানিগুলো খুব ভালোভাবেই জানে কিশোর-তরুণরা এই বয়সে নতুন বা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণের ফলে ধূমপানের চেষ্টা করতে পারে। আর একবার যে কোনো উপায়ে তাদের ধূমপানের অভ্যাস করাতে পারলেই তারা সফল। আজীবন তাদের একজন ক্রেতা তৈরি হয়ে গেল।

অন্যদিকে, আজীবন ক্রেতা মানে তাদের আজীবন মুনাফা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত খসড়া মূল সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হলে তামাক কোম্পানির এই কূটকৌশল আর কাজে লাগবে না। কারণ প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার ধারা ৫-এর (ক) উপধারা (১) এ বলা হয়েছে- ক্রেতার নিকট বিক্রয়ের সময় ব্যতীত বিক্রয়স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য বা তার মোড়ক বা প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হবে।

উপরোক্ত প্রস্তাবনাটি কেন সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত হয়েছে তা নিচের কিছু পরিসংখ্যান এবং রিপোর্ট লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এভিডেন্স ব্রিফ- টোব্যাকো পয়েন্ট অব সেল ডিসপ্লে ব্যানস এবং নরওয়ের স্কেফেলস জে এবং লাভিক আর-এর একটি গবেষণা বলছে, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কিশোরদের মধ্যে সিগারেট ক্রয়ে উৎসাহিত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিসিডি’র স্মোক ফ্রি পলিসিস ইমপ্রুভ হেলথ এবং ২০১৯ সালের ভ্যান হার্ক এমএম, নাইটস পিএডব্লিউ এবং অন্যান্যর ইমপ্যাক্ট অব রিমুভিং পয়েন্ট-অফ-সেল টোব্যাকো ডিসপ্লেস অন স্মোকিং বিহ্যাভিয়ার অ্যামং অ্যাডোলোসেনস ইন ইউরোপ: এ কুয়াইসাই এক্সপেরিমেন্টাল স্টাডি নামক গবেষণা বলছে, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হলে দৈনিক ধূমপানের প্রবণতা প্রায় সাত শতাংশ হ্রাস পায়। কিশোর বয়সিদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা হ্রাসে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার কার্যকর প্রভাব রয়েছে। এছাড়া টোব্যাকো ট্যাকটিকস নামক সংস্থার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধের পর আইসল্যান্ড ও কানাডায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপানের হার ১০ শতাংশ কমেছে।

উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে, কিশোর-তরুণদের ধূমপান ও তামাকের স্বাস্থ্যক্ষতি এবং এর বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের সুস্থ সবল জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের মূল সংশোধনীর ধারায় বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে আইনটির খসড়া সংশোধনী মন্ত্রীপরিষদে উত্থাপনের অপেক্ষায় আছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনীটি দ্রুততম সময়ে পাশ হলেই ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তামাকমুক্ত হওয়ার পথে অনেক দূর অগ্রসর হবে।