ঊর্ধ্বমুখী বাজারে পুষ্টিতে ঘাটতি

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কারওয়ান বাজার রেলগেট ধরে একটু সামনে গেলেই দেখা মিলবে রেললাইনে বসানো হয়েছে- শাকসবজি, মাছের ছোট ছোট দোকান। এ বাজারের সব পণ্যই নিম্নআয়ের মানুষের জন্য। যেসব শাকসবজিতে একটু পচন ধরেছে বা যানবাহনে বহন করে আনার সময় নষ্ট হয়ে গেছে, এমন শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসেছেন এখানের বিক্রেতারা। কারওয়ান বাজারে যেসব মাছ নষ্ট হয়ে গেছে বা ফেলে দেয়া হয়েছে, সেসব মাছ এখানে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এ বাজারের নাম ‘ফকিন্নি বাজার’। এখানে মূলত সামাজের নিম্ন আয়ের মানুষ বাজার করতে আসেন। এখানে ১০০ টাকা নিয়ে বাজার করতে এসেছেন ৫০ ঊর্ধ্ব আঞ্জুমানা বেগম। তার সঙ্গে কথা বলতেই তিনি জানান, ১০০ টাকায় তিনি বাজারটি থেকে শাকসবজি ও মাছ কিনে নিতে চান। শাকসবজি আর মাছ ক্রয়ের পর টাকা থাকলে তিনি একটু তেলও কিনে নিতে চান। কিন্তু এ টাকায় তিনি বাজার শেষ করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। কারওরান বাজারে সকালের প্রাতঃভ্রমণ শেষে পরিবারের পাঁচ সদস্যের জন্য দৈনন্দিন বাজার করতে এসেছেন আজিজুল হক। পেশায় তিনি একজন সরকারি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। বাজারের বর্তমান অবস্থা জানতে তার সঙ্গে কথা বলতেই তিনি অনেকটা ক্ষোভ জাড়লেন। তিনি বললেন, অনেক জিনিস খাওয়া বাদ দিয়েছি। সবজি বলতে বাসায় নিচ্ছি শুধু পেঁপে। তাও ৪০-৫০ টাকা কেজি। ২৫ টাকার আলু ৫০ টাকার ওপর। অন্য শাকসবজি খাওয়া অনেকটা বাদ দিয়েছি। ৬০-৮০ টাকা দিয়ে সবজি কিনে খাওয়ার মতো আয় আমার নেই। আগে খেতাম রুই মাছ; এখন খাই তেলাপিয়া অথবা পাঙাস মাছ। এতেও শান্তি নেই; ১৮০-২০০ টাকার তেলাপিয়া হয়ে গেছে ২৫০ টাকা। ডিমের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, আমি ও আমার স্ত্রী ডিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ছোট তিনটি ছেলেমেয়ে আছে। তারা তো বোঝে না, তাই কষ্ট হলেও তাদের জন্য ডিম কিনতে হয়। ৩৫ টাকার ডিমের হালি এখন ৫০ টাকা। আমরা যাব কোথায়! ফলমূল কেনেন কি না জানতে চাইলে বলেন, বাচ্চাদের জন্য কলা কিনেছি। আপেল, কমলা, আঙ্গুরের দাম শুনলে তো চমকেই উঠি। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে সিনিয়র সেলস ম্যানেজার পদে চাকরি করেন পলাশ আহমেদ। সাপ্তাহিক বাজার তিনি এক দিন এসে সেরে নেন। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতেই অনেকটা আক্ষেপের সুরে বললেন, ৮০ হাজার টাকা বেতন পেয়েও দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। শাকসবজি কিনতে পারছি, মাছ-মাংস কিনতে গেলে দু-তিনবার চিন্তা করতে হয়। দুই বছর আগেও এ সময় প্রায় ইলিশ মাছ কিনে নিতাম বাসার জন্য। এ বছর সম্ভব হচ্ছে না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন মাহমুদুল হাসান। থাকেন পুরান ঢাকার একটি মেসে। প্রস্তুতি নিচ্ছেন সরকারি চাকরির। তার সঙ্গে কথা বলতেই জানালেন জীবনযুদ্ধে তার টিকে থাকার গল্প। তিনি বলেন, পরিবারের সামর্থ্য নেই পড়াশোনা করার জন্য টাকা পাঠানোর। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাচ্ছি, চাকরির ফরম পূরণ, মেস ভাড়া দিয়ে খাবারের টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস অবস্থা। তিনি বলেন, শেষ কবে রুই মাছ খেয়েছি মনে নেই। আলুর ভর্তা আর ডিম দিয়ে জীবন চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আলু আর ডিমের দামও বেশ বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে গরু ও খাসির মাংস বিক্রি করেন মোল্লা জলিল। তিনি বলেন, গরু আগে দিনে বিক্রি করতাম দুটি। এখন একটি জবাই করি। সারাদিন বসে থাকলেও বিক্রি হয় না। বিকালে হোটেল সাপ্লাইয়ে দিয়ে দিই। তিনি জানান, গত তিন-চার বছর আগেও দিনে ৮-১০টি খাসি জবাই করেছি। এখন গড়ে দুই থেকে তিনটি জবাই করছি।

বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ খাবারের পুষ্টিগুণের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে কোনো রকমে বেঁচে থাকার। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানবদেহের পুষ্টিতে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে মানবদেহে বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিম্নআয়ের মানুষ দৈনিক আয়ের বড় একটি অংশ খাবারের পেছনে ব্যয় করেন। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তার আয়ের পুরোটাই ব্যয় করতে হচ্ছে খাবারের পেছনে। তারপরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সে তখন ভাতের সঙ্গে আমিষ খাওয়াটা কমিয়ে দিয়ে খরচ বাঁচাতে চেষ্টা করে।

এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয় পরিবারের শিশুরা। এতে তাদের যে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি হওয়ার কথা, ছোটবেলা থেকে তা আর হচ্ছে না। এই যে পুষ্টির অভাবে যে ক্ষতি শিশুদের হয়ে যাচ্ছে, আমরা এটাকে অপূরণীয় ক্ষতি বলি। শিশু ছাড়াও একজন স্বাভাবিক মানুষ যদি তার দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি না পায়, তাহলে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও পুষ্টির ঘাটতি নিয়ে আমার সংবাদের এ প্রতিবেদক কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, মানবদেহে পুষ্টির দরকার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ সময় মানুষকে খরচ কাটছাঁট করে চলতে হচ্ছে। দাম নাগালের মধ্যে আছে- এমন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য দিয়ে খাবার তালিকা সাজাতে হবে।

এতে করে পুষ্টির ঘাটতি কম হবে। সাধারণ মানুষের আয় ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। মানুষ কষ্টে আছে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বাজার এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাজার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের দৌরাত্ম্য না কমাতে পারলে বাজারের দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা কমবে না।