ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কন্যাশিশুর সামাজিক নিরাপত্তা

শুধু আইন করে নয়, চাই সম্মিলিত উদ্যোগ
কন্যাশিশুর সামাজিক নিরাপত্তা

আইন ও সালিশকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, দেশে যত সংখ্যক নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তার চেয়ে বেশি হয় কন্যাশিশু। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে মোট ২২৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর একই সময় ১০৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। নারীর চেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয় ১০৬ শতাংশ বেশি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল দেশে পালিত হলো আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। ২০২২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে মোট ২ লাখ ৫২ হাজার ৮২১টি সহায়তা চেয়ে কল আসে। তার মধ্যে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত ৬৯৮টি। ২০২২ সালে প্রকাশিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের ‘বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি’ শীর্ষক জরিপে দেখা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা নিজের বাড়ি- কোনো জায়গাতেই নিরাপদ থাকতে পারছে না কন্যাশিশুরা। অসংখ্য মেয়ে নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছেই দিনের পর দিন শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৫৫ ভাগ শিশু নিজের পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য বলছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে মোট ৩২৯ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, কন্যাশিশুর ওপর যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে পর্নোগ্রাফি। এ বছর প্রথম ৮ মাসে পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে ৩০ জন কন্যাশিশু। কন্যা শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিত্বরা বলছেন বাল্যবিবাহ দেওয়া খুবই সাধারণ বিষয় বলে সমাজে ধরে নেওয়া হয়। মেয়েদের ১৫, ১৬, ১৭ বছরে বিয়ে হবে, এটাকে কেউ ক্ষতিকর বলে মনে করে না। দরিদ্র্যের সঙ্গে এখন সামাজিক কারণগুলোও যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা জন্মনিবন্ধন, কাজিদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে দেখি না। ফলে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছি।

তাই শুধু আইন করে নয়, সামাজিকভাবে সম্মিলিতভাবে সরকার ও সুশীল সমাজকে কাজ করতে হবে। যৌন হয়রানি রোধে ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার রোধ করতে হবে। শিশুদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি না করে গভীর সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। পরিবারের মধ্যে শিশু ধর্ষণ রোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামল উদ্দিন আহমেদ পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, শিশু ধর্ষণ রুখতে যেমন আইনে প্রয়োজন, তেমন ওইসব মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য শাস্তির বিধান করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের সমাজের অনেকেই পৃথিবীতে কন্যাসন্তানের আগমনকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেন না। যেসব পিতামাতার ছেলে সন্তান নেই এবং যাদের একাধিক কন্যাসন্তান রয়েছে, তারা প্রতিনিয়ত একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হন ‘তাহলে কি কোনো ছেলে নেই’। ‘অমুকের সব সন্তানই মেয়ে’। কন্যাসন্তানদের লালনপালন করে তাদের শিক্ষিত করে একটা যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দেয়ার মনমানসিকতা প্রতিটি অভিভাবক পোষণ করেন। কন্যাশিশু জন্মের পরই তার পিতামাতা ওই সন্তানটির ব্যাপারে সচেতন হন। যোগ্য করে গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে এ আশঙ্কায়। একটা মেয়ে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলে বাবা-মায়ের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। তবে কোনো ছেলে রাতে বাসায় ফিরলে তার বাবা-মায়ের জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয় না।

কন্যাসন্তান নিয়ে অভিভাবক, বিশেষ করে মায়েদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময় তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অভিভাবকদের ভাবিয়ে তোলে। আমাদের চারপাশের রাস্তার মোড় কিংবা দোকানের সামনে কিশোর বয়সি ছেলেরা আড্ডা দেয়। তারা মেয়েদের দেখলে নানা অশ্লীল বাক্য ছুড়ে দেয়। এসব ছেলেদের কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। অথচ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় বাড়ির মালিক সমিতি কিংবা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন রয়েছে, তারা একটু সচেতন হলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। কন্যাসন্তানদের নিয়ে আমাদের দেশের অভিভাবকরা যেভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকেন, সেটা উন্নত কোনো দেশের অভিভাবকরা থাকেন না। সে কারণে আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক নির্দ্বিধায় তার কন্যাসন্তানটিতে সভ্য দেশে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। কেননা, সেখানকার সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক ভালো। গভীর রাতেও চলাফেরায় নিরাপত্তা বোধ হয়। আমাদের দেশটি সেই অবস্থায় যাবে, যেদিন রাতে-দিনে কোনো সময় মানুষ রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকবে না। নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরাল ভূমিকা রয়েছে, তেমনি সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত