অক্টোবরজুড়ে উদ্বোধনের মহোৎসব

তাপস হালদার

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অক্টোবর মাসজুড়ে সরকারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন হচ্ছে। ৫ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম হস্তান্তর ও ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, ২০ অক্টোবর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু ও ২৮ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব মেগা উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা জনগণের কাছে উন্নয়নের উপহার তুলে দিচ্ছেন। এরইমধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের সুফল জনগণ পাচ্ছে। অক্টোবর মাসেই আরো অনেক মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দৃশ্যপটই বদলে যাবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আসে। আর ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া হয়। দেশের সবচেয়ে একক বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের সিংহভাগ অর্থাৎ ৮০ শতাংশ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে রাশিয়া। মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। আর ২০২৬ সালে বাকি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল অপরূপ সৌন্দর্যে নির্মাণ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সিপিজি কর্পোরেশন (প্রা.) লিমিটেডের বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিনের নান্দনিক নকশায় তৈরি। রোহানি বাহারিন সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর, ভারতের আহমেদাবাদ, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ বিমানবন্দর টার্মিনাল, চীনের গুয়াংজুর এটিসি টাওয়ারসহ বহু আন্তর্জাতিক স্থাপনার নকশা করেছেন। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ে প্রকল্পটি সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক ও দুবাই বিমানবন্দরের মতো আধুনিক নান্দনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি করা হয়েছে। নির্মাণ করেছে জাপানের মিৎসুবিশি, ফুজিটা ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং কোম্পানি। বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে দুইটি টার্মিনাল আছে। যার বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা ৮০ লাখ। আর তৃতীয় টার্মিনালের যাত্রী ধারণক্ষমতা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। সবমিলিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় দুই কোটি। পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এই টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি প্লেন পার্কিং করতে পারবে। টার্মিনাল ভবন দুই লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটার। যাত্রীদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা বিমানবন্দরের ভেতরে দীর্ঘপথ হাঁটতে পারবেন না, তাদের জন্য আছে স্টেইট এস্কেলেটর। তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেল। বিদেশ থেকে যাত্রী এসে বিমানবন্দর থেকেই মেট্রোরেলে উঠে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। এছাড়া মেট্রোরেলের যে কোনো স্টেশন থেকে উঠে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই বিমানবন্দরে ঢুকতে পারবেন। যাত্রী হয়রানি দূর করতে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করবে জাপান। টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য তৈরি হচ্ছে মুভি লাউঞ্জ, ফুডকোর্ট, ফুড গ্যালারি, এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডে রুম, ওয়াই-ফাই ও মোবাইল চার্জিং সুবিধা, কেনাকাটার জন্য ১৪টি স্পটে ডিউটি ফ্রি শপ এবং যাত্রীদের নিতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য মিটার্স অ্যান্ড গ্রিটার্স প্লাজা। শিশুদের স্তন্যপানের জন্য মায়েদের ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা ও ফ্যামিলি বাথরুম। বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ চিলড্রেন প্লে এরিয়া। ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসকসহ হেলথ ইন্সপেকশন সুবিধা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু গতবছর উদ্বোধন হয়েছে, অপেক্ষা ছিল পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ। এবার সেটিও পূর্ণ হলো। এর মধ্য দিয়ে রেলওয়ে যোগাযোগে স্বপ্নের মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেল চালু হলো। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পটি প্রায় ৪০ হাজার কোটি ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে রেল সংযোগ তৈরি করেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)। এটি বাংলাদেশের প্রথম পাথর বিহীন রেললাইন। এরইমধ্যে চীন থেকে নির্মিত ১০০টি অত্যাধুনিক কোচ আনা হয়েছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরমধ্যে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার চালু হলো। এবং ২০২৪ সালের মধ্যেই রেল যাবে যশোর পর্যন্ত। তখন রাজধানী ঢাকা থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। পদ্মা রেল সেতু বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মেট্রোরেল ঢাকা শহরে গণপরিবহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্তমানে মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলমান আছে। এটি মতিঝিল পর্যন্ত চালু করা হচ্ছে। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০১৭ সালে শুরু হয় মেট্রোরেলের কাজ। নির্মাণ ব্যয় হয় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। শুরুতে মেট্রোরেলের পরিকল্পনায় ছিল উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। এই অংশ উদ্বোধন করা হবে। পরবর্তীতে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়, যা ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে। পরিপূর্ণভাবে চালু হলে উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। যানযট মুক্ত আধুনিক, সময় সাশ্রয়ী ও বিদ্যুৎ চালিত হওয়ায় দূষণমুক্ত মেট্রোরেল নগর গণপরিবহণে মাইলফলক হয়ে থাকবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ টানেল হল সুড়ঙ্গ সড়ক। যা কর্ণফুলী নদীর দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হয়েছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। চীনের এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। টানেলে দুটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। একটি দিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারার দিকে অন্যটি আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা হয়ে শহরের দিকে আসা যাবে। এছাড়া এ মাসেই ১৪০টি সেতু, ১২টি ওভারপাস ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভিআইসি) উদ্বোধন করা হবে। আরো উদ্বোধনের তালিকায় আছে, কক্সবাজার রেলস্টেশন। যেটি দেশের প্রথম আইকনিক স্টেশন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। যা রেলের যাত্রী সেবায় নতুন দিগন্ত তৈরি হবে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, আখাউড়া-আগরতলা ও খুলনা-মোংলা রেললাইন। যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজও শেষ পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মেগা প্রকল্পগুলো চালু হওয়ার কারণে বদলে গেছে বাংলাদেশ। অক্টোবর মাসেই খুলে যাচ্ছে উন্নয়নের আরো অনেক নতুন দুয়ার। ফলে আরো সহজ হবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্যে আসবে গতি, বাড়বে কর্মসংস্থান। সামগ্রিকভাবেই দেশের আরো সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।