ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবার ও অভিভাবকের করণীয়

সালমা তালুকদার
পরিবার ও অভিভাবকের করণীয়

কিছুদিন আগে একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি প্রচণ্ড আপসেট হয়ে আছেন। আমাকে বললেন, আমার দুটি ছেলে। একজন ক্লাস নাইনে পড়ে। আরেকজন সিক্সে। একদম কথা শোনে না। বাবা-মা হিসেবে আমাদের একদম মানতে চায় না। আমি তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘আমার বাচ্চারা রাত ১টা পর্যন্ত মুভি দেখে। আমার বাসায় টিভি, ট্যাব, কম্পিউটার সব আছে। আমি ওদের কিছুতে বাধা দিই না। এখনকার যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে না? এই যদি হয় বাবা-মায়ের অবস্থা, তাহলে সন্তানরা কী শিখবে! সন্তানের বাবা-মা হলে নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। এক কথায় নিজের লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করতে হয়, যা দেখে সন্তানরা ভালো কিছু শিখবে, যা দেখে সন্তান কখনো বাবা-মায়ের ওপর আঙুল তুলে বলতে পারবে না, আমাকে এই কাজটা করতে না করে তুমি কেন করছ? বাবা-মা যদি সারা দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে সময় কাটায় তাহলে সন্তানকে এসব বিষয়ে না করার পক্ষে কোনো যুক্তি থাকে না। তাই বলে বলছি না এসব থেকে একেবারে দূরে রাখতে। একেবারে না দিলে তখন আবার সন্তানরা বাইরে কোথাও খুঁজে নেবে। মিথ্যে বলে বন্ধুদের বাসায় সময় কাটাবে। বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। এবং ইন্টারনেটের ভালো-খারাপ দিক সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের সমস্যা খুঁজে নিয়ে যেমন কাজ করতে হয়, ঠিক তেমনি নরমাল শিশুদেরও বিভিন্ন বয়সে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেগুলো নিয়ে বাবা-মায়ের কাজ করতে হয়। জন্মের পর থেকে শুরু করে বয়োসন্ধিকাল পর্যন্ত সময়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জন্মের পর যেমন শিশুর খাবারের ব্যাপারে বাবা-মা অনেক বেশি সচেতন থাকেন, ঠিক তেমনি শিশু যখন বুঝতে শিখে তখন বাবা-মাকে আরো বেশি সচেতন হতে হয়। বিশেষ করে বয়োসন্ধিকালে শিশুর ভেতরে যে পরিবর্তন ঘটে, সেটার সঙ্গে শিশু অনেক সময় পেরে ওঠে না। সেই সময়টায় বাবা-মাকে খুব সাবধানতার সঙ্গে শিশুকে মানসিক সাপোর্ট দিতে হয়। শিশুর মন বুঝে কাজ করতে হয়। তাহলে সে কখনো রাস্তা হারাবে না। মোটকথা সন্তানকে নৈতিক আদর্শ দিয়ে বড় করাটা বাবা-মায়ের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বৈকি! ইদানীং অভিভাবকরা ভালো রেজাল্টের জন্য ছেলেমেয়েদের ওপর প্রেশার দেন। একবারও ভাবেন না সন্তানের ব্রেন কতটুকু নিতে পারছে। একবারও ভাবেন না সন্তানের পুস্তকের জ্ঞানের চাইতে ভালো মানুষ হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। একবারও ভাবেন না সমাজে বিভিন্ন পেশার লোক বসবাস করেন। সবাই যদি অফিসার হয় তবে কেরানি হবে কে? তার মানে এটা বলছি না যে জেনেশুনে ছেলেমেয়ে নিম্নস্তরের কোনো কাজে ঢুকতে সাহায্য করা। বলার অর্থ হচ্ছে, মেধা অনুযায়ী রিজিক মানুষ পেয়েই যায়। তার বাইরে অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে বন্ধু বানিয়ে তাকে যত্নের সঙ্গে মানুষ করা। এবং তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলা। সংসারজীবনে প্রবেশ করা আর সন্তানের বাবা-মা হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সন্তান নেওয়ার আগে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে সঠিকভাবে লালন-পালন করার মতো তৈরি আছি কি না। সন্তান হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে অনেক বড় নেয়ামত। কোনোভাবেই তাকে অবজ্ঞা করা যাবে না। একটা ভালো প্রজন্মের ওপর একটা উন্নত জাতি নির্ভর করে। আর এই প্রজন্ম তৈরির দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তা বাবা-মাকে দিয়েছেন। সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে আসার আগে কী ছিলাম সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, একজন মানবসন্তানকে কীভাবে নৈতিক আদর্শে বড় করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। সন্তানকে সঠিকপথে রাখতে হলে অনেক সময় দিতে হবে। পরিবারে একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে খেলতে হবে। বাইরে ঘুরতে যেতে হবে। মোটকথা কাজের বাইরের সময়টুকু সন্তানকে দিতে হবে। আজকাল অভিভাবকদের বলতে শুনি, তাহলে কি আমার নিজের কোনো জীবন নেই? এবং এই কথাটা এখন মানুষের বুলিতে পরিণত হয়েছে। আর এই কথার মধ্য দিয়েই অনেক পরিবারে ভাঙ্গনের সুর শোনা যায়। কিন্তু একবার যদি চিন্তা করি, ‘ছোট একটা জীবনে এই একটা কথা কত বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে, তা হলে কেউ আর এই কথাটা বলবে না।’ মানুষের আয়ু বড়জোর ৬০ বছর। অথবা ৭০ বছর। আরো অনেক বছর অনেকে বাঁচেন। কিন্তু বাঁচার ধরনের ওপর ভালো থাকাটা নির্ভর করে। আজকে যদি আমার সন্তানকে আমি সঠিক পথ না দেখাই, পরে আমি তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারি? সন্তানের মন বুঝে পর্যাপ্ত সময় না দিলে সেই সন্তান নিজে নিজে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়। কখনো এই মানবশিশু জীবনে একজন ভালো মানুষ হয়। কখনো একদমই নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে গেলে নিজেকে দেওয়া সময়ের পাশাপাশি অনেক বড় একটা সময় সন্তানকে দিতে হবে। পারিবারিক কলহ ব্যাপারটা অনেক পরিবারে লেগেই থাকে। কেউ বলতে পারবে না কোনো পরিবারে স্বামী-স্ত্রীতে বিবাদ হয়নি। কিন্তু এই পারিবারিক বিবাদ সন্তানের মনের ওপর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করে সেটা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? দেখিনি। তাৎক্ষণিক কিছু বোঝা যায় না অনেক সময়। কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়ী কুফল সন্তানের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই উচিত স্বামী-স্ত্রীর বিবাদগুলো বন্ধ দরজার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখা। আর যদি একজন কোনোভাবেই এতে সম্মত না হন, সেক্ষেত্রে অন্যজনকে কঠোর ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। দিন শেষে সেই-ই জয়ী হবে। কেননা আমরা জানি আল্লাহ সব সময় ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। সবশেষে বলতে চাই মানসিক সমস্যা সবারই থাকে। এটা একটা অসুখ। বড়দের, ছোটদের সবারই হয়। শরীরের অসুখটা বাইরে থেকে দেখা যায়। কিন্তু মানসিক অসুখ দেখা যায় না। সেটা উপলব্ধি করতে হয়। তাই এখন থেকে আমরা চেষ্টা করব নিজের মনটাকেও সুস্থ রাখার। যদি মনে হয় নিজের মনে কোনো অসুখ বাসা বেঁধেছে তবে তার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট, কাউন্সেলররা আছেন। তাদের মাধ্যমে খুব সহজে মনের অসুস্থতা দূর করা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত