প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও শিশুর বিকাশ

রাসেল হাসান

প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিশু জন্মের পর প্রথম কথা বলতে শিখে তার মা-বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে। চারপাশের লোকজনের কাছ থেকে সে যে ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্য শোনে- তাই বলার চেষ্টা করতে থাকে। এভাবে সে রপ্ত করে তার মায়ের ভাষা। সামাজিক বিকাশের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষার রূপকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বা আনুষ্ঠানিক-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য এই তিন ধরনের শিক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বিশেষভাবে পরিকল্পিত পাঠ্যক্রম রয়েছে এবং অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় কোনো পাঠ্যক্রম এবং কাঠামো নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুর অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তার জন্মের পর থেকেই চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়ে। সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলা এবং মেলামেশার মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক অজানা বিষয় শিশু জেনে নেয়। বর্ণমালা শেখার মাধ্যমে শিশুর প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়। তবে সত্যিকার অর্থে বিদ্যালয়ে সে তিন ধরনের শিক্ষারই সুযোগ পায়। সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা এবং ব্যবহারিক বিষয়ের মাধ্যমে বিদ্যালয় থেকে সে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সে সময় অনলাইনে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য বিদ্যালয় থেকে যে তিন ধরনের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। করোনা মহামারি কমে যাওয়ায় বিদ্যালয়গুলো আবার আগের মতো শিশুদের কোলাহলে মুখরিত হচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারের বিস্তার ঘটছে। পাশাপাশি, কর্মব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মা-বাবা এখন শিশুদের বেশি সময় দিতে পারেন না। আগের দিনে শিশুরা তাদের দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির কাছ থেকে গল্প, কিচ্ছা কাহিনির মাধ্যমে অনেক অজানাকে জানতে পারত। তাদের মুখে নীতিকথা শোনে নিজেদের মধ্যে একটা আদর্শ মানদ-ের ভিত তৈরি করে নিতে পারত। বেশির ভাগ একক পরিবারে শিশুরা এখন দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিকেও কাছে পায় না। এসব কারণে টিভি কিংবা ইন্টারনেটে কার্টুন দেখা ও ভিডিও গেমস খেলার প্রতি শিশুদের আসক্তি দিন দিন বেড়ে চলছে। গ্রামের শিশুরা এখনো মুখরিত ছেলেবেলার সুযোগ কিছুটা পেলেও শহরকেন্দ্রিক শিশুদের এই সুযোগ এখন সীমিত।

৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি, সে সময় যোগাযোগব্যবস্থা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। তবে সকালবেলায় ধানখেতের পাশ দিয়ে হেঁটে দল বেঁধে স্কুলে যাওয়ার মধ্যেও বিশাল আনন্দের সঞ্চার হতো। স্কুলের অবকাঠামোগত অবস্থাও এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। এখনকার মতো বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই পাওয়া যেত না। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণি কার্যক্রমের সুবিধা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। শিক্ষাব্যবস্থাকে ৪টি স্তরে ভাগ করা যায়। যথা- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিতে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। শিশুর মানসিক, প্রাক্ষোভিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশ শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। চারিত্রিক গুণাবলির গঠনও শুরু হয় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। যে শিশু প্রাথমিক স্তরে নিজেকে পরবর্তী স্তরের জন্য প্রস্তুত করতে পারে না সে অনেকে ক্ষেত্রেই পরবর্তী স্তরে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না এবং পরে ঝরে পড়ে। উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে দরকার মেধাবী ও আদর্শ চারিত্রিক গুণাবলিসম্পন্ন নাগরিক। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু পুঁথিগত বাক্য মুখস্থ করানো নয়। প্লেটো শিক্ষাকে শনাক্ত করেছেন ন্যায়বিচার অর্জনের উপায় হিসেবে। শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো নৈতিকতা এবং অন্তর্নিহিত মহত্ত্বের বিকাশ ঘটানো। জোহান হেইনরিখ পেস্তালতজির মতে, ‘শিক্ষা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ’। আর তাই শ্রেণিকক্ষে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি শিশুর চরিত্র গঠনের জন্য শিক্ষক তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিহার্য। হেনরি এডামস তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।’ একজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর ওপর যেভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন তা অন্য কেউ পারে না। বর্তমান ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থায় শিশুর বিকাশে পরিবারের প্রভাব আগের চেয়ে কমতে থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাবকের দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই সম্মানিত শিক্ষকদের এই পরিস্থিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর দেশপ্রেমিক, নীতিবান আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আমাদের সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফলতা অর্জন সম্ভব।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কুড়িগ্রাম সদর, কুড়িগ্রাম।