ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সময়ের দাবি

রায়হান আহমেদ তপাদার
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সময়ের দাবি

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ভীষণ কষ্টের মুখে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে দেশের গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু কেন জানি তাদের মৌলিক দাবিগুলো বারবার অধরাই থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষদের পরিস্থিতি কী? তাদের যে মজুরি দেওয়া হয়, তা কি মানবিক জীবনযাপন করে শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের জন্য যথেষ্ট? বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে অর্ধেক আয় করেন দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে নিয়মিত বিরতিতে ২০০৬, ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি ঘোষিত হয়েছে। সর্বশেষ তিনবার ঘোষণা করা হয়েছে বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে। এ সময়ে মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় যেমন আংশিক উন্নতি হয়েছে, তেমনি মজুরি নির্ধারণে দুর্বলতাও দেখা গেছে; বরং বলা চলে, মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় দুর্বলতার পাল্লাই ভারী। বিগত দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন-পরিবর্ধন জরুরি। দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই। এই না থাকা অর্থনীতির দুর্বলতা ও অসংগঠিত অবস্থা, আর সেই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা নির্দেশ করে। বিভিন্ন খাত ধরে অবশ্য ন্যূনতম মজুরির বিধান আছে; কিন্তু সেটাও ঠিকমতো কার্যকর নয়। বাংলাদেশে বৃহত্তম রপ্তানিমুখী শিল্প খাত তৈরি পোশাক, সেখানেই ন্যূনতম মজুরির খুবই দীনদশা। বহু রকম সভা-সমাবেশ-আন্দোলন করেও তারা সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্ত এই মজুরি পাওয়ার অধিকার শ্রমিকদের আছে, তা আমরা কেন ভুলে যাই। বেশ কিছুদিন ধরে তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলন, দাবি-দাওয়া চলছে। মজুরি বোর্ড গঠিত হয়েছে, কিন্তু এখনো অস্বচ্ছ, অনিশ্চিত পরিস্থিতি। অন্য খাতগুলোর অবস্থা চিন্তা করাও কঠিন। ২০১৮ সালে গার্মেন্টস খাতে যে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়, তা ছিল বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের দাবির ৫০ শতাংশ, মাত্র ৮ হাজার টাকা। মূল মজুরি বাড়ানো হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা, আর এই বৃদ্ধির অজুহাতে মালিকদের নানাবিধ সুবিধা সে সময় আরো বাড়ানো হয়। সে সময় পোশাক কারখানার মালিকরা তৈরি পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি যতটুকু বাড়বে, সরকারের কাছ থেকে তার সমপরিমাণ সুবিধা দাবি করেন। সে জন্য তারা সরকারের কাছে নতুন করে কর হ্রাস ও নগদ সহায়তার দাবি তোলেন। দাবি তুলে অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের, শ্রমিকদের মতো মাসের পর মাস কোনো মিছিল-মিটিং করে হতাশও হতে হয়নি। যেদিন এই দাবি জানানো হয়, সেদিনই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এ দুই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি ছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকের উৎসে কর কমিয়ে দেওয়া হয়, করপোরেট করও কমানো হয়। তবে কেন শ্রমিকদের মজুরির ব্যাপারে এতটাই উদাসীন, সেই জায়গাতেই প্রশ্ন তুলেছেন অভিজ্ঞ মহল। ২০২০ সালের শুরুতেই করোনা এসে মহাবিপর্যয় তৈরি করে। এ সময় বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, অসুস্থতার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। এরপর শুরু হয়েছে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জিনিসপত্রের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি, এর সঙ্গে বাসভাড়া, বাসাভাড়া- সবই বেড়েছে এবং বৃদ্ধির দাপট এখনো চলছে। এখন আবার চলছে ডেঙ্গু, যার জন্য শ্রমজীবী মানুষের কাজ, আয়ের ক্ষতি ছাড়াও চিকিৎসার বাড়তি ব্যয় বড় ধাক্কা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামই বেড়েছে বেশি। ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর টিসিবির হিসাবে এ রকম বিভিন্ন পণ্যের দামে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার দেখা যায়।

২০১৮ সালে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ২০২৩ সালে এসে প্রকৃত মূল্যে হয়ে গেছে ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে ৫ হাজার টাকার কম। তাহলে বলা যায়, ২০১৮ সালের ৮ হাজার টাকার ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে টাকার অঙ্কে শ্রমিকদের এখন দেওয়া উচিত ১১ হাজার টাকার বেশি। শ্রমিকদের আয় বাড়েনি, কিন্তু ডলারের বিনিময়ে টাকার দাম কমে যাওয়ায় মালিকপক্ষ গত ১ বছরে বাড়তি পেয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরপরও মজুরি বাড়ানোর যৌক্তিকীকরণের প্রশ্ন উঠলে নানা কুযুক্তি শোনা যায়। যেমন- দেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম। সে জন্য মজুরিও কম। এটা ঠিক যে শ্রমিকদের বা শ্রমের উৎপাদনশীলতা আরো বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু এটাও পরিষ্কার থাকা জরুরি যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা আসলে নির্ভর করে মালিকদের ভূমিকার ওপর; নির্ভর করে প্রযুক্তি, কর্মপরিবেশ, ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, মজুরি, পুষ্টি ও অবসরের ওপর। এগুলো সবই মালিকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম থাকলে তার দায়িত্ব প্রধানত মালিকদেরই, শ্রমিকের নয়। আরো যুক্তি শোনা যায়, তৈরি পোশাকশিল্পের সামর্থ্য নেই। মজুরি বাড়ালে শিল্পে ধস নামবে ইত্যাদি। সব পরিসংখ্যান বরং এই যুক্তির বিপক্ষেই যায়। আন্দোলন ও জনমতের চাপে বিভিন্ন সময়ে যতটুকু মজুরি সমন্বয় করা হয়েছে, তাতে এই শিল্পের ধস নামতে দেখা যায়নি, বরং আরো বিকাশই দেখা গেছে। ১৯৯৪ সালে মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা, গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি আয় তখন ছিল ২০৯ কোটি ডলার, ২০০৬ সালে তা বেড়ে হয় ৬০০ কোটি ডলার। ২০০৬ সালে মজুরি ১ হাজার ৬৬২ টাকা নির্ধারণ করার পর ২০১০ সাল নাগাদ গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করার পর ২০১৩ সালে গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি আয় হয় ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।

২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করার পর ২০১৮ সাল নাগাদ মজুরি বৃদ্ধির দাবি ওঠার সময় রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে ৮ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের পর তা বাস্তবায়ন করা হয় ২০১৯ সালের শুরুতে। এরপর শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমেছে, জীবন-জীবিকার সংকট বেড়েছে। কিন্তু গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি বেড়েছে উল্লেখ যোগ্য হারে, ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার থেকে তা এখন ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ এই শিল্পের সক্ষমতা বাড়ছে, বিশ্ববাজারে তার অবস্থানও শক্তিশালী হচ্ছে। একটি পরিবারের টিকে থাকার সামগ্রী দিয়ে নিম্নতম মজুরির হিসাব করা হয়। তাই নিম্নতম মজুরি কোনো যুক্তিতেই দরিদ্র্যসীমার আয়ের নিচে হতে পারে না। দেশে দরিদ্র্য দ্রুত কমে যাচ্ছে, এ প্রচারণা খুব জোরদার। কিন্তু দরিদ্র্য মাপার হিসাব-নিকাশ খুব অস্বচ্ছ। বিশ্বব্যাংক এবং সরকারের হিসাবে দরিদ্র্যসীমার আয় কম করে দেখানোর ছলচাতুরী নিজেরা একটু হিসাব করলেই ধরা পড়ে। সরকারের পারিবারিক আয় ও ব্যয় জরিপই এ বিষয়ে তথ্যের প্রধান উৎস। এর সর্বশেষ প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে চলতি বছরের গত এপ্রিল মাসে। সেখানে দেশে গড় কিলোক্যালরি ভোগ দেখানো হয়েছে মাথাপিছু দৈনিক ২ হাজার ৩৯৩। এই পরিমাণ শক্তি পেতে বিভিন্ন পণ্যের গড় ভোগের পরিমাণও দেখানো হয়েছে। পণ্যগুলো হলো মোটা চাল, গম, ডাল, দুধ, তেল, মাংস, মাছ, আলু, সবজি, চিনি ও ফল। এখানে আবশ্যকীয় ডিম ধরা হয়নি। শ্রমিকদের কাজের ধরন অনুযায়ী দিনে প্রয়োজনীয় কিলোক্যালরি লাগে কমপক্ষে তিন হাজার। কিন্তু সরকারি দরিদ্র্যসীমার উচ্চতর রেখার জন্য প্রয়োজনীয় কিলোক্যালরি ধরা হয় প্রায় ২ হাজার ২০০ কিলোক্যালরি। এই পরিমাণ শক্তি পেতে সরকার-নির্দেশিত পণ্যগুলোর বর্তমান বাজারদর হিসাব করলে দেখা যায়, চারজনের পরিবার প্রতি কমপক্ষে ২৩ হাজার টাকা প্রয়োজন। এর সঙ্গে বাসাভাড়া, বাসভাড়া, চিকিৎসা, বাচ্চাদের লেখাপড়া ইত্যাদি একেবারে কম করে ধরলেও ৪০ হাজার টাকা। তাছাড়া ঢাকায় বাস করলে, তা প্রায় ৫০ হাজার টাকা দাঁড়ায়। তাহলে শ্রমিকের মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবি তো বরং অনেক কম, মালিকদের তো উচ্ছ্বসিতভাবে এই দাবি অবিলম্বে মেনে নেওয়া উচিত। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের মজুরিসংক্রান্ত দাবি কোনো দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, মালিকরাও শ্রমিকের মা-বাবা নন। কোনো শ্রমিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করে, এখন যে মজুরি পান, সেটা স্বাভাবিক আয় নয়- ৮ ঘণ্টা কাজ করেই তার বাঁচার মতো মজুরি পাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না কেন, এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে? এক ব্যক্তির যা আয় করার কথা, তা যদি পরিবারের দুই থেকে তিনজনের আয় দিয়েও পূরণ না হয়, তাহলে তা খুবই অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক পরিস্থিতি। আর সেটাই এখন চলছে দেশে, যার পরিবর্তন অবশ্যই হতে হবে। তা শুধু একটি খাত নয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি হতে হবে বাঁচার মতো। সুতরাং শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি।

সরকার ঘোষিত আইনি কাঠামো পরিপালনে বিদেশি ক্রেতারা নীতিগতভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। এর আগে দেখা গেছে, অনেক ক্রেতা সরকার ঘোষিত নতুন মজুরি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন না। সুতরাং নতুন ঘোষিত মজুরি কাঠামো আইনগতভাবে পরিপালনে ক্রেতাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে সব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি, বায়ার্স ফোরাম এবং ব্র্যান্ডগুলোর কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া উচিত। ২০১৮ সালে মজুরি ঘোষণার পর কিছু ক্রেতা এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ঘোষিত নতুন মজুরির বাড়তি অংশের ব্যয় এককভাবে যেন মালিকদের ওপর চাপানো না হয়, সেই ঘোষণা ক্রেতারা দিতে পারেন। একই সঙ্গে ক্রেতাদের দেওয়া বাড়তি মজুরির মূল্যাংশ যেন শ্রমিকের পান, সেটি নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকা প্রয়োজন। এসব বিষয় যথাযথভাবে বাস্তবায়নে শ্রমিকদের মজুরিসহ পাওনা ডিজিটাল বা অনলাইনভিত্তিক হওয়া জরুরি বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত