ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাটশিল্পের উন্নয়নে পদক্ষেপ জরুরি

আরিফ আনজুম
পাটশিল্পের উন্নয়নে পদক্ষেপ জরুরি

বাংলাদেশকে সোনালি আঁশের দেশ বলা হয়, সোনালি ফসলের সমৃদ্ধ দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। পাটকে আমরা মূলত সোনালি ফসল বলে থাকি। একদল বিজ্ঞানী তোষা পাটের পর দেশি পাটের জীবন রহস্য বা জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। বলা হচ্ছে, এর ফলে বাংলাদেশ তার পাটের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। জমকালো এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে এ সুখবরটি জানানো হয়েছে। কিন্তু সুখবরটি মিলিয়ে না যেতেই জানা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান রাজনৈতিক সংকটে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাজার ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ ও শংকা বিরাজ করছে কৃষক, রপ্তানিকারক ও শিল্প মালিকদের মধ্যে। অবস্থাদৃষ্টে বলতে হয়, আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে পাট রপ্তানির বিষয়টি। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, চলতি অর্থ বছরে কাঁচা পাট রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমবে। পাট ও চটের বস্তা কমপক্ষে ২৫ ও পাট সুতা ৫ শতাংশ রপ্তানি কমবে। আরব বসন্তের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বিরাজ করছে অস্থিতিশীলতা। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পাটের বাজারে। কেননা, দেশের পাটজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান ও লিবিয়া। এমন কি লিবিয়া থেকে বাংলাদেশি পাট পণ্য রপ্তানি হতো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। স্বাভাবিক ভাবেই এসব দেশের রাজনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের পাটশিল্পে। এতে ক্রমেই কমছে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি। পাটশিল্পের এ সংকটে বিপাকে পড়েছে উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষক ও শ্রমিকদের। বলাবাহুল্য, এক সময় পাট ছিল আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৯০ শতাংশই আসত কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি থেকে। ৪৭-এর দেশভাগের আগে তৎকালীন পূর্ব বাংলা ছিল পাট উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। ৬০ দশকে বাংলাদেশের পাট ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়। পুরো পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট। কিন্তু এই বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ ব্যয় হতো তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এই পাটকে ঘিরে। তখন ভাবা হতো পাট বাংলাদেশের মানুষেরই কাজে লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ শিল্পের সমৃদ্ধ অবস্থা বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি। ক্রমবর্ধমান লোকসানে একটির পর একটি পাটকল বন্ধ হতে থাকে। পাট শিল্পের বিকাশে যে নগদ সহায়তা দেয়ার কথা, সরকারের কাছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে নগদ সহায়তা ১০ থেকে কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। সময়ের পরিক্রমায় সোনালি ঐতিহ্য পাট এখন মুমূর্ষু শিল্প। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রতিবেশী দেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য সংকট আমাদের পাটশিল্পের সম্ভাবনাকে আরেক দফা হুমকিতে ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

কোনো শিল্প সংকটে পড়লে অবস্থার উত্তরণে অবশ্যই বিকল্প আছে। তবে প্রথমেই প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। কিন্ত পাটশিল্পের জন্য সেই বিকল্প ব্যবস্থা কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। আগে ৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে যে পরিমাণ পাট ব্যবহৃত হতো, এখন তার দ্বিগুণ জনসংখ্যা হলেও সেই অনুপাতে পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়েনি। তাই প্রথমেই আমাদের পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। যেহেতু অন্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই, তাই বিদেশনির্ভর না হয়ে পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাজার বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী পরিবেশসচেতনতার প্রেক্ষাপটে টেকসই উন্নয়নের উপাদান হিসেবে উন্নত দেশগুলোয় পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ সুযোগ বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে পাট সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশ শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু শিল্পায়নের পাশাপাশি কৃষিকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। শুধু একটি পণ্যের দিকে মনোযোগ দিলে অর্থনীতির জন্য তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন বর্তমানে আমাদের রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ আসে পোশাকশিল্প থেকে। অনেক সময় পোশাকশিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় যা আমাদের রপ্তানি আয়কে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই কৃষিভিত্তিক দেশীয় শিল্পকে বিকশিত করতে হবে। বিশেষ করে পাটশিল্পকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাট উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে বাংলাদেশে যে মানের পাট উৎপন্ন হয় শিল্পক্ষেত্রে তার সঠিক ব্যবহার করাটাই পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। এজন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও পাটনীতি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাহলেই পাটশিল্পকে একটি শক্তিশালী শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক : সহকারী শিক্ষক

আমতলী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত