বাঁচাতে হবে বিপন্ন এ পৃথিবীকে

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অন্যতম একটি আলোচিত বিষয় হচ্ছে, ক্লাইমেট চেঞ্জ অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন। প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী কে? পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র, যা প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। এর পরেই আসছে রাশিয়া, ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশ। জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করছে অস্ট্রেলিয়া। সে তুলনায় বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনের হার অত্যন্ত কম, শতকরা প্রায় শূন্য দশমিক দুই ভাগ মাত্র। এতে বোঝা যায়, উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে দায়ী। অথচ দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এখানে বন্যা, আকস্মিক বন্যা, ঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও লবণাক্ততা ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে।

উত্তরাঞ্চলে খরা ও মরুপ্রবণতা দেখা দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ঝড় ও সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হলে বাংলাদেশের নদী-মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চলের লোকদের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। যার প্রমাণ বিগত বছরগুলোর ভয়াবহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা। দেশে সিডর, আইলা বা ইয়াসের মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস। কত মৃত্যু যে দেখতে হয়েছে আমাদের, কত শত বাড়িঘর ভেঙে গেছে- আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। সম্প্রতি (১৪ মে ২০২৩) দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় মোখা। যদিও যেভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে ঘূর্ণিঝড় হয়নি। গত ২২ বছরের মধ্যে যে ক’টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত করেছে, তার মধ্যে মোখা সবচেয়ে কম সময় ভূখণ্ডে অবস্থান করে। ঝড়টি বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে যাওয়ার সময় ছিল মাত্র ৬ ঘণ্টা। আর ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানার সময় সাগরে ভাটা চলছিল। ফলে জলোচ্ছ্বাসও কম হয়েছে। ঝড়টির কেন্দ্র মূলত মিয়ানমারে আঘাত হানে। ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলে হয়েছে ভয়াবহ বন্যা।

উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলাসহ বিভিন্ন এলাকা এবার আকস্মিকভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে। অন্যদিকে, উজানের পানি একতরফাভাবে ভারত আটকে রাখার ফলে প্রমত্ত পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তার মতো নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানি সংকটের কারণে যেমন বিভিন্ন এলাকা বা অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ুুর পরিবর্তন নিঃসন্দেহে এ অবস্থাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।

সাধারণত শক্তিশালী কোনো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর বড় অঞ্চলজুড়ে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা কমে আসে। কিন্তু এবারের ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার সময় এবং আগে-পরে দেশে দাবদাহ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি আবহাওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্বের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, গত এপ্রিলের মতো চলতি মে মাসেও বাড়তি উত্তাপ থাকতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আশপাশের রাজ্য, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে।

আইপিসিসি’র সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমান সময়ের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্ষাকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় শীতকালে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার হবে বেশি। শীতের তীব্রতা অনেকটাই কমে যাবে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে গরমের মাত্রা ক্রমেই বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। ১ কোটি মানুষ এরই মধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্থতে পরিণত হয়েছেন। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন। এদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই জলবায়ু উদ্বাস্তু।

বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ুর পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হওয়ার প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ হতে পারে। তবু তারা আশাবাদী, যথাযথ ব্যবস্থা ও কর্মসূচি গ্রহণ করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে রাখা সম্ভব হতে পারে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে এমন দিনের সংখ্যা আশির দশকের তুলনায় বর্তমানে দ্বিগুণ বাড়ছে। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৪ দিন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল বছরে ২৬ দিন। গত ১৫ জুলাই ২০২২ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের একটি মাত্রাচিত্র প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, ওইদিন দুপুরে স্পেনের সেভেলি শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ইরানের আহভাজ শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৪৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চীনের সাংহাই শহরের তাপমাত্রা উঠেছে ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ বড় শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। সহজেই বুঝতে পারছি, কী এক কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।

যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা ‘নোয়া’ (ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৩ বছর ধরে বৈশ্বিক আবহাওয়ায় ‘লা নিনা’ পরিস্থিতি ছিল। লা নিনা সক্রিয় থাকলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। কিন্ত এ বছর এসব অঞ্চলগুলোতে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি (উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত) তৈরি হচ্ছেন। এতে তাপমাত্রা বেশি থাকবে এবং বৃষ্টি কম হতে পারে। আবহাওয়া অস্বাভাবিক চরম আচরণ করতে পারে। এর কারণেই অতিরিক্ত উষ্ণতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আজ আমরা পরিবেশ এবং প্রকৃতির যে ভয়াবহ রূপ ও পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছি, যেভাবে দিন দিন অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, আকস্মিক ঝড়-বন্যা- তাতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশ, বাঁচাতে হবে বিপন্ন এ পৃথিবীকে।