ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রক্ত দিন জীবন বাঁচান

জিল্লুর রহমান
রক্ত দিন জীবন বাঁচান

রক্তদান একটি মহৎ কাজ। রক্তদান করা মানে মানবতার কল্যাণে পাশে থাকা। রক্তদানের মাধ্যমে হাজারো মুমূর্ষু ব্যক্তিদের জীবন বাঁচতে পারে। একবার রক্ত দানে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে। এ কাজটি সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করার মতো একটি মহৎ কাজ। এ কাজে সমগ্র মানবজাতি যেমন উপকৃত হয়, তেমনি ব্যক্তিগতভাবেও লাভবান হওয়া যায়। এ কাজে মেলে মানসিক পরিতৃপ্তি এবং এতে জাগ্রত করে মানবিক অনুভূতি।

রক্তদানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৯২ সালে অষ্টম পোপ যখন স্ট্রোক করেন তখনকার চিকিৎসকরা ধারণা করেছিলেন, পোপের মনে হয় শরীরের কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই ভেবে পোপকে বাঁচানোর জন্য ১০ বছর বয়সের তিনজন ছেলের শরীর থেকে রক্ত বের করে পোপকে পান করানো হয়েছিল। কারণ তখন রক্তনালি বলে কিছু আছে, সেটিই তাদের জানা ছিল না। তাই সবাই মনে করতো রক্ত খেলেই সেটা শরীরে ঢুকে পড়বে। মাত্র একটা স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সেই তিন বাচ্চার রক্ত নেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনক হলো, রক্ত নেওয়ার ফলে তিনটা বাচ্চাই মারা যায়। কিন্তু পোপ বেঁচে যান। সবাই ধারণা করেছিল, সেই রক্তের জন্যই পোপ বেঁচে গেছেন। পরের বছর পোপ সেকেন্ড স্ট্রোক করে মারা যান কোনো ঘোষণা ছাড়াই। তারপর থেকে কেউ আর রক্ত দিতে সাহস করেনি। পরবর্তীতে ১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানতে পারে, মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়। ১৬৬৬ সালে ডা. রিচার্ড লোয়ার সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। ১৬৭৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ১৮১৮ সালে ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম একজন মানুষের শরীরে আরেকজন মানুষের রক্তই দেওয়া যাবে প্রমাণ করেন। ১৯০১ সালে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার দেখান, মানুষের রক্তের প্রধানত চারটি গ্রুপ রয়েছে- এবিএবি এবং ও। ১৯৩০ সালে রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। প্রথমবারের মতো মানুষ বুঝল যে, গত ২৭২ বছর ধরে তাদের ভুলটা ঠিক কোথায় হচ্ছিল। তিনি ১৯৪০ সালে আবার আরএইচ গ্রুপ আবিষ্কার করেন, যা আমরা পজিটিভণ্ডনেগেটিভ রক্ত বুঝতে পারি। ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করানো হয়। এ ধারণা থেকেই ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা ও মেডিক্যাল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন। ১৯২১ সালে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে ব্রিটিশ রেডক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেন। সূচিত হয় বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত। তবে স্বেচ্ছায় রক্তদান নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে অনেক ভুল ধারণা। এই ভুল ধারণাকে কাটিয়ে উঠে স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষ যত বেশি এগিয়ে আসবে, তত কল্যাণ হবে পৃথিবীর। রক্ত দিতে খুব একটা সাহসের প্রয়োজন হয় না। আবার রক্তদান করা কোনো নায়কোচিত কাজও নয়। তবে এটি অত্যন্ত মহৎ একটি কাজ। যে কেউ চাইলেই রক্তদান করতে পারে না। রক্তদাতার কিছু করণীয় বা কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। রক্তদান করতে হলে রক্তদাতার বয়স আবশ্যই ১৮ হতে হবে এবং ওজন হতে হবে কমপক্ষে ৪৮ কেজি। তাকে সুস্থ হতে হবে। রক্তদাতার যদি কয়েক মাসের মধ্যে কোনো বড় ধরনের অপারেশন না হয়ে থাকে; জণ্ডিস ও ম্যালেরিয়া জাতীয় অথবা রক্তসংক্রান্ত কোনো অসুখে না ভোগেন, তাহলেই তিনি রক্তদান করতে পারে। রক্তদানের সময় দাতার রক্তচাপ অবশ্যই স্বাভাবিক থাকতে হবে। এসব ঠিক থাকলেই শুধু একজন ব্যক্তি রক্তদান করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, রক্ত মানুষের শরীরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকলেও কেউ রক্ত দেয়, আবার কেউ রক্ত নেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে রক্ত সাধারণত শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো প্রয়োজন ও কারণ ছাড়া একজনের রক্ত অন্যের শরীরে স্থানান্তর করা হারাম। তবে রক্ত দান না করলে জীবনহানি ঘটতে পারে, এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। বরং এ ক্ষেত্রে ইসলাম আরো উৎসাহ দিয়েছে। এক্ষেত্রে রক্তদাতা সদকায়ে জারিয়া হিসাবে সওয়াবের অধিকারী হবে। দ্বিতীয়ত, রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা নেই বটে; কিন্তু রক্ত দেওয়া ছাড়া তার জীবনের ঝুঁকি বাড়ে অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হয়; এমন অবস্থায় রক্ত দেওয়া জায়েজ ও জরুরি। তৃতীয়ত, যখন জীবননাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, বরং শুধু শক্তি বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্য হয়; সে অবস্থায় ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রক্তদান জায়েজ নয়। নিয়মিত রক্তদানে হৃদরোগ ও হার্ট-অ্যাটাকের ঝুঁকি ৮৮ শতাংশ হ্রাস করে। কারণ রক্তদানে শরীর প্রতিবারই নতুন, শক্তিশালী লাল রক্ত কোষ তৈরি করছে এবং সান্দ্রতা হ্রাস করে। তা ছাড়া, নিয়মিত রক্তদান রক্তে কলেস্টোরেলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে। রক্তদানে প্রতিবার মাত্র ১০-১২ মিনিটি সময় প্রয়োজন হয়। রক্তদানের এই ১০-১২ মিনিটে সিটে শুয়ে শুয়ে একজনের শরীর থেকে খরচ হবে ৬৫০ ক্যালরি। যা খরচ করতে তাকে ৩০ মিনিটি ব্যায়ামাগারে পরিশ্রম করতে হয়। প্রতিটি রক্তদান ১৩টি পরীক্ষার মধ্যদিয়ে সম্পন্ন হয়, এর মধ্যে ১১টি পরীক্ষা করা হয় এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি এবং সিফিলিসের মতো সংক্রামক রোগের জন্য। প্রতিবার রক্ত দানের সময় এর কোনোটিতে যদি পজেটিভ পাওয়া যায়, তাহলে তার শরীরে থাকা রোগ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। নিয়মিত পরীক্ষা না হলে হয়তো একজনের শরীরে থাকা রোগ সম্পর্কে জানতে অনেক দেরিও হয়ে যেতে পারে। রক্তের প্লাজমা পূর্ণ হতে এক বা দুই দিন সময় নেয়, কিন্তু লাল রক্তকোষ সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হতে চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লাগে। রক্ত দেওয়াতে একজন যে আয়রন হারাচ্ছে, তা পূর্ণ হতে আরো বেশি সময় লাগে। আয়রনের পরিমাণ আগের পর্যায়ে পৌঁছাতে আট সপ্তাহও লাগতে পারে। এ কারণে রক্তদানের ৫৬ দিন অতিবাহিত না হলে পুনরায় রক্ত না দিতে বিশেষজ্ঞগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে ৩৭ শতাংশ লোক রক্তদানে যোগ্য বা সক্ষম। যোগ্যদের মাত্র ১০ শতাংশ লোক নিয়মিত রক্ত দান করে থাকেন। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, প্রত্যেক যোগ্য ব্যক্তি যদি বছরে নিয়মিত তিন বার রক্ত দান করত, তাহলে রক্তের অভাব হওয়ার ঘটনা ঘটত না। কিন্তু বাস্তবে নিয়মিত রক্তদানকারী গড়ে বছরে দুইবার রক্তদান করেন। রক্তদানের পরিমাণ ছুটির মৌসুমে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র পাঁচজন লোক স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন।

জানা যায়, প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর। আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, নিরাপদ রক্ত সরবরাহের মূলভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্ত দান। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী রক্তদান সংগঠন গড়ে উঠেছে, যেমন সন্ধানী, বাঁধন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, রেটিনা ইত্যাদি। মেডিক্যাল কলেজভিত্তিক ‘সন্ধানী’ সংগঠনটি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বড় রক্তদাতা সংগঠন ‘বাঁধন’ ‘একের রক্তে অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন’ স্লোগান নিয়ে ১৯৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে এবং বিগত ২৫ বছরে সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া কিছু সংগঠন সম্পূর্ণ অনলাইনে রক্তদানের কাজ করছে যেমন- ব্লাড ডোনেশন বাংলাদেশ, প্রভাত ব্লাড ডোনেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ব্লাড ব্যাংক, কল ফর ব্লাড, কণিকা, রক্ত দাও জীবন বাঁচাও, হাদী ব্লাড ব্যাংক, আশার আলো ব্লাড ডোনেশন ইত্যাদি। এক ব্যাগ রক্ত হাসি ফোটাতে পারে একজন মায়ের, একজন বাবার, একজন স্ত্রীর, একজন সন্তানের, সর্বোপরি একজন মুমূর্ষু রোগীর। হয়তো একজনের রক্তে বেঁচে যেতে পারে একটি পরিবারের একমাত্র আয় উপার্জনকারীর। তাই আসুন একটু সচেতন হই, স্বেচ্ছায় রক্তদান করি, মানুষের জীবন বাঁচাই, ধরে রাখি একটি পরিবারের হাসি-কান্না ও আনন্দ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত