ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশবান্ধব শকুন হারিয়ে যাচ্ছে

হৃদয় দেবনাথ
পরিবেশবান্ধব শকুন হারিয়ে যাচ্ছে

মৃতপ্রাণীর দেহ থেকে রোগ-জীবাণু ছড়ানো ঠেকাতে শকুনের বিকল্প নেই। এই উপকারী পাখিটি মৃতপ্রাণীর মাংস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সহায়তা করে। সারাবিশ্বে রয়েছে মোট ১৮ প্রজাতির শকুন। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ছয় প্রজাতির শকুন। তবে এর মধ্যে ‘বাংলা শকুন’কেই অন্যতম মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও শকুন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় এ শকুন দিবসটি। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম Gyps bengalensis। লম্বায় ৯০ সেমি. ও ওজনে ৪ দশমিক ৩ কেজি। পালক ময়লা কালচে বাদামি। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ প্রজননকাল। বাসার আকার বেশ বড়। একই বাসা ঠিকঠাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। স্ত্রী শকুন সাদা রঙের একটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ৪০-৪৫ দিনে। শকুন তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী। এটি মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। সাধারণত এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে থাকে এবং প্রাণীটির মরার জন্য অপেক্ষা করে। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোনো পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে ওড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে বট গাছ, ডুমুর গাছ প্রভৃতি বিশালাকার গাছে সাধারণত শকুন বাসা বাঁধে। গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় ১-৩টি সাদা বা ফ্যাকাসে ডিম পাড়ে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সঙ্গে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির। এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুনের মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও এতে আছে রাজ শকুন, গ্রিফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। তবে শুধু গ্রিফন প্রজাতির শকুনই মাঝেমধ্যে দেখা যায় (পরিপ্রেক্ষিত-২০১০)। এসব প্রজাতির শকুনই সারা বিশ্বে বিপদাপন্ন। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজ শকুন মহাবিপন্ন। এটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্যে ঠোঁটে পাথরের টুকরো বহন করে ও ডিমের উপর নিক্ষেপ করে। বাংলাদেশের এখন অতি বিপন্ন একটি প্রাণীর নাম শকুন। দেশটিতে এখন সব মিলিয়ে তিনশটির কম শকুন রয়েছে। অথচ এক সময়ে প্রায় সর্বত্রই দেখা মিলত বৃহদাকার এই পাখিটির। এখন শুধুমাত্র মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বনে এবং সুন্দরবন এলাকায় কিছুটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় শকুনের দেখা মেলে। এসব এলাকাকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকাও ঘোষণা করেছে সরকার। তবে ইদানীং বিভিন্ন দেশে, গবাদিপশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের ব্যথানাশক ওষুধের প্রভাবে শকুন মারা যাচ্ছে। এ কারণে ডাইক্লোফেনাক ওষুধটি ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দুই ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। ফলে মৃত গবাদিপশুর মাংস খেয়ে মারা যাচ্ছে মহাবিপন্ন এই পাখিটি। পরিবেশবাদী ও পাখি বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক উদ্বেগ ও প্রচারণার পর ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয় বাংলাদেশে। তবে এখনো দেশে ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে ডাইক্লোফেনাকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শকুন বিলুপ্তির মুখে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত পশুর মাংস শকুনের কোনো ক্ষতি করে না; কিন্তু ডাইক্লোফেন দেওয়া হয়েছে, এমন মৃত পশুর মাংস খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে শকুনের মৃত্যু ঘটে। এ কারণে গত তিন দশকে (২০১০) উপমহাদেশে ৭৫ শতাংশ শকুন মারা গেছে। ১৯৮০-এর দশকে সার্কভুক্ত দেশে প্রায় ৪,০০,০০,০০০ শকুনের অস্তিত্ব ছিল, অথচ এ সংখ্যা এখন কমে মাত্র ৪০,০০০-এ এসে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন-এর গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনেনাক ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। ভারতে প্রতি বছর ৩০ শতাংশ শকুন মারা যাওয়ার কারণও এ নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক ওষুধটি। ২০০৩ সালের পর থেকে শকুন অধ্যুষিত দেশগুলোতে এই ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং শকুন টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রতি হাজারে একটিতে। অচিরেই ডাইক্লুফেনাক-এর বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা না চালালে মহাবিলপ্ত এই পাখিটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়!

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত