অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক শেখ রাসেল

রহিমা আক্তার মৌ

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘আল্লাহর দোহাই, আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকব। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে হাসু আপা ও দুলাভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিন।’ এমন আকুতি ভরা কথাগুলো মনে পড়লে চোখ ভারি হয়ে আসে। চোখের সামনে ১০ বছরের শেখ রাসেলের ফুটফুটে ছবিটা ভাসে। ছবিই তো আমি চিনি পত্রিকায় দেখেছি বলে। দেখবই বা কি করে। শেখ রাসেলসহ তার পরিবারকে হত্যার কয়েক মাস পর জন্ম আমার। তাই পড়ে পড়েই জানতে হয় বিষয়গুলো। শেখ রাসেলকে নিয়ে পড়তে গিয়েই কথাগুলো জানতে পারি। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ রাসেল। শুভ জন্মদিন রাসেল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শেখ রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। সবার আদরের রাসেল। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র তারই নামে প্রতিষ্ঠিত। রাসেলের ভাই-বোনের মধ্যে অন্যরা হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম সংগঠক শেখ কামাল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ জামাল এবং শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পরিবারে রাসেল যেমন ছিল সবার আদরের স্কুলেও ছিল সবার প্রিয়। ছোট্ট রাসেল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হয়েই সবার মন জয় করেছেন। রাসেলের নাম রাখায় রয়েছে একটি মজার পটভূমি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। রাজনীতির সঙ্গেই যার বসবাস। জেল খাটতে হয়েছে যাকে সেই কলেজে থাকতেই। জেলে বসেও প্রচুর পড়াশোনা করতেন বঙ্গবন্ধু। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিল বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় একজন লেখক। তিনি মাঝে মাঝে বই পড়ে শেখ রাসেলের মা শেখ ফজিলতুন নেছাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের দার্শনিকতা। এসব শুনে রাসেলের ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনিও। সেখান থেকেই নিজের ছোট সন্তানের নাম রেখে দেন রাসেল। সত্যিকারের একজন দেশ নেতার সন্তানরা বাবাকে কাছে পায় খুব কমই। বঙ্গবন্ধুর সন্তানরাও বাবাকে কাছে পেয়েছেন খুব কম। তার মাঝে ছোট সন্তান শেখ রাসেল তো অনেক কমই পেয়েছেন বাবাকে কাছে। তাই তিনি মাঝে মাঝেই মাকে বাবা বলে ডাকতেন। এটা একটা স্বাভাবিক ডাক নয়। একটি শিশুর কাছে তার বাবা হলেন নিরাপদ আশ্রয়। বাবার জন্য তার মনে কতটা অপেক্ষা তা বুঝা যায়। বাবা ডাকার মাঝে যে শান্তি তাই হয়তো একটু উপভোগ করতেন মাকে বাবা ডেকে। বঙ্গবন্ধু ঘরে ফিরেই ছোট ছেলেকে নাম ধরে ডাকতেন। দেশের গল্প শুনাতে শুনাতে ঘুম পাড়াতেন। বুকের উপর ঘুমিয়ে রাখতেন। এসব আসলে পড়ে পড়েই জানা। জন্মের পর থেকেই রাসেল বাবাকে খুব কম কাছে পেয়েছেন। ১৯৬৪ সালে জন্ম তার। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘৬ দফা দাবি’ পেশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে মিল রেখে ২৩ মার্চ। ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালির মুক্তির সনদও বলা হয়। ‘কারাগারের রোজনামচা ’ শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন: ‘৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ওতো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ এই ছিল শেখ রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আদর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবন ঘিরে ফেলে শেখ মুজিব, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবের নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা তাদের আটক করে। আর শিশু রাসেলসহ সবাইকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তারা বেঁচে যান। খুনিরা সেদিন রাতে সবাইকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চাইলেও এটাই সত্যি ‘রাখে আল্লাহ্ মারে কে’ বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শুধু এবার নয়, পরপর তিনবারের সংসদের নেত্রী নির্বাচিত হন। ১৫ আগস্ট যে শুধু রাসেলকে হত্যা করেই ছেড়েছে তা নয়। নিজের চোখে ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল শেখ রাসেলকে। বত্রিশ নম্বরের দুইতলা থেকে যখন তাকে নিচতলায় আনা হলো তার শিশু মন ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছিল। আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম যিনি বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ির রিসিপশনিস্ট ছিলেন তিনি এই নৃশংস ঘটনার সাক্ষী। সেই অন্ধকার রাতে রাসেল তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো?’ মুহিতুল আশ্বস্ত করেছিলেন না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না। হয়তো তিনি নিজেও বিশ্বাস করেছিলেন যে, এ রকম একটি নিষ্পাপ শিশুর শরীরে কোনো জঘন্যতম পাপীও আঘাত করতে পারে না। কিন্তু মুহিতুলের সেই বিশ্বাস ভাঙতে সময় লাগেনি। বত্রিশ নম্বরের বাড়ি ছোট্ট রাসেলের রক্তে লাল হয়ে যায়।

১৯৮৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন যাতে করে এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রিয়া সংগঠনের মাধ্যমে শিশু শেখ রাসেলের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারন করে এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। শেখ রাসেলের স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি বাংলাদেশের ‘বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ফুটবল ক্লাব’। ১৯৯৫ সালে পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে খেলার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ক্লাবটি। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষদের কাছে ভালোবাসার নাম। অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রামগঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদণ্ডলোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছেন। দেশবাসীর দাবি ছিলো বঙ্গবন্ধু ও শিশু রাসেল হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা। উপযুক্ত সাজা দেয়া। বঙ্গবন্ধুর কন্যা তাই করেছেন। বিচার হয়েছে, সাজা হয়েছে। এখন দাবি যেসব ঘাতক এখনো বিদেশের মাটিতে পালিয়ে আছে তাদের দেশে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। প্রয়াত সংসদ সদস্য, সাংবাদিক এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবি মওদুদের লেখনির মাধ্যমে জানতে পারি রাসেল সম্পর্কে অনেক কিছু। তিনি লিখেছেন- ‘রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আব্বার কাছে যাবে না?’ মা কোনো উত্তর দেন না।

শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কি মা?’ মা বলেন, ‘কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’ রাসেল উত্তর দেয়, ‘সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।’ এমন রাজনৈতিক সচেতন ছিল শেখ রাসেল এবং কারাগারে বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জয় বাংলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল এবং বাবার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মাঝে মধ্যে ঝাঁঝালো উক্তি প্রদান করতেন। রাসেলকে নিয়ে পড়তে পড়তে হিসাব করে দেখি সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। বেঁচে থাকলে এতদিনে বয়স হতো ৫৮ বছর। রাসেলের জন্মদিন পালন করা হয় শিশু কিশোরদের নিয়ে। শিশু রাসেল যেন এখনো আছে সেই চেনা স্কুলের পথে, সেই বত্রিশ নম্বারের বাড়িতে। অপেক্ষা করছে বাবার ফেরার, অপেক্ষা করছে বাবার মুখে গল্প শোনার। আর বড় বুবুর সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। ১৯৭৫ সালের পর রাসেল আর একটি মাত্র শিশু নয়, রাসেল সবার অজান্তেই মনের মাঝেই অনেক অনেক শিশু বৃদ্ধদের মাঝে স্মৃতি হিসাবেই আছে। মো. সাখাওয়াত হোসেন নিজের ‘বঙ্গবন্ধু পরিবারের মধ্যমণি শেখ রাসেল’ লেখায় লিখেছেন- ‘রাসেলের চরিত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল, গাম্ভীর্যতাও লক্ষ্য করা গেছে। পরিস্থিতি এবং সময়ের দাবি মিটিয়ে রাসেল তাল মিলিয়ে চলেছেন। বাড়িতে দুষ্টুমি করত সবসময়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সফরে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন সর্বদাই। অনুষ্ঠান এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখেই পোশাক পরিধান করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল। সচরাচর প্রিন্স কোট, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিবকোট পরত রাসেল। বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরিধানেও মাঝেমধ্যে নজরদারি করতেন ছোট্ট শেখ রাসেল। শেখ রেহানার বর্ণনামতে জানা যায়, একবার বঙ্গবন্ধু বন্যার্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর পোশাক, পায়ের স্যান্ডেল কী হবে ঠিক করে দিয়েছিলেন শেখ রাসেল। পরিবারের অন্যদের ভালো-মন্দের বিষয়ে নজরদারি করতেন শেখ রাসেল।