ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধান কোন পথে!

মো. রায়হান আলী, আইনজীবী ও কলামিস্ট, জেলা আইনজীবী সমিতি, খুলনা।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধান কোন পথে!

বিশ্বের সব চেয়ে পুরাতন সংকটের অন্যতম ফিলিস্তিন সংকট। ইহুদি ও মুসলিমের মধ্যে বিরোধপূর্ণ এক আলোচিত যুদ্ধ। এ সংঘাতের ঘটনা আজ নতুন কিছু নয়। বর্তমান যুদ্ধের আগে ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৪, ২০২১ সালেও ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছে। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইল ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে, বহু এলাকা দখল করে নিয়ে ইহুদি বসতি স্থাপন ও লোক স্থানান্তর করেছে। এ যুদ্ধের বিস্তর ইতিহাস রয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সম্রাজ্যের পরাজয়ের পর, ব্রিটেন ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা তখন ইহুদি সংখ্যালঘু এবং আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি আবাসভূমি তৈরি করার দায়িত্ব দেয়, যা মুসলমানদের গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তোলে। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে যেতে শুরু করে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইউরোপে ইহুদি নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ভয়ংকর ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরির স্বপ্ন দেখছিল। ফিলিস্তিনে তখন ইহুদি আর আরবদের মধ্যে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা।

একই সঙ্গে সহিংসতা বাড়ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেও। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনকে দুই টুকরো করে পৃথক ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়, যেখানে জেরুজালেম থাকবে একটি আন্তর্জাতিক নগরী হিসেবে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু আরব নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশরা এই সমস্যার কোনো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ছাড়ে এবং ইহুদি নেতারা এরপর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। বহু ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ জানালে শুরু হয় যুদ্ধ। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘরবাড়ি ফেলে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বা ‘মহা-বিপর্যয়’ বলে থাকে। পরের বছর যুদ্ধবিরতির মধ্যদিয়ে যুদ্ধ শেষ হয়। ততদিনে ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চল ইসরাইলের দখলে। ১৯৬৭ সালে আরেকটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পূর্ব-জেরুজালেমসহ বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। ইসরাইল এখন পুরো জেরুজালেম নগরীকেই তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব-জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে চায়। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ হাতে গোনা কয়েকটি দেশ। গত ৫০ বছর ধরেই ইসরাইল এসব দখলিকৃত জায়গায় ইহুদি বসতি স্থাপন করছে। ছয় লাখের বেশি ইহুদি এখন এসব এলাকায় থাকে।

ফিলিস্তিনিরা বলছে, আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অবৈধ বসতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। তবে ইসরাইল তা মনে করে না।

ফিলিস্তিনের কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংগঠন হামাস। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরাইলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরাইলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাদের লক্ষ্য, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরাইল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র। ইতিহাস বলছে প্রায় আট দশক ধরে সংঘাত চলছে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল অঞ্চলে। এই সংঘাত-সহিংসতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ সংঘাত শুধু ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ না থেকে এই ইস্যু নিয়ে বিরোধের হাওয়া-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে। ইসরাইল-হামাসের চলতি যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপীই। চলতি মাসের ৭ তারিখ ভোরে হামাস যোদ্ধারা অতর্কিতে ইসরাইলে প্রবেশ করে হামলা চালায়। জবাবে গাজায় বোমাবর্ষণ শুরু করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ইসরাইলের বিমান হামলায় গাজা শহরের বিভিন্ন এলাকা ধূলোয় মিশে গেছে।

হামাসের হামলায় ইসরাইলে অন্তত ১ হাজার এবং গাজায় ৮০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে। ইসরাইল সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের পাশাপাশি হামলা আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।

এ যুদ্ধ নিয়ে উভয় দেশের নেতাদের পাল্টা-পাল্টি সিদ্ধান্তের ঘোষণা ও নিজ নিজ অনঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ‘দখলদার সন্ত্রাসী ও দখলকারীদের’ বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রয়েছে ফিলিস্তিনি জনগণের। অপরদিকে, এদিকে ইসরাইল যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

অপরপ্রান্তে, এদিকে ইসরাইল যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ৭ অক্টোবর, ইসরাইলিদের উদ্দেশ্যে এক উববয়ভাষণে তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের জনগণ, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। আমরা জিতব।’ তিনি বলেন, গত শনিবার সকালে ইসরাইল ও ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ও আকস্মিক হামলা চালিয়েছে হামাস। আমরা সকাল থেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আছি।’ ‘আমি নিরাপত্তাব্যবস্থার সব প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছি। প্রথমত যারা ইসরাইলে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের নির্মূলের নির্দেশ দিয়েছি, এ অপারেশন এ মুহূর্তে চলছে।

বহু দেশে অসংখ্য মানুষ ফিলিস্তিনদের পক্ষে বিক্ষোভণ্ডসমাবেশ করছে। মুসলিম দেশগুলোতে বিক্ষোভকারীদের প্রধান স্লোগান হচ্ছে, ‘ইসরাইলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। ‘বদরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ ‘বিশ্ব মুসলিম ঐক্য গড়ো, ফিলিস্তিন স্বাধীন করো’। পশ্চিমা দেশগুলোতেও ইসরাইল ও ফিলিস্তিনদের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক মিছিল-মিটিং হচ্ছে। রাশিয়া বলেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য সমাধান। ইইউ ফিলিস্তিনিদের সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকা ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধাস্ত্র প্রেরণ করেছে। এ যুদ্ধে ইসরাইলকে সামরিক সহায়তা করার তীব্র নিন্দা করেছে রাশিয়া।

উভয় দেশই এক একটা বৃহৎ ধর্মের মতাদর্শে বিশ্বাসী।

ইসরাইল দেশটি ইহুদি অধ্যশিত এলাকা এবং ফিলিস্তিন দেশটি মুসলিম অধ্যশিত এলাকা। ফলে এ যুদ্ধে বর্তমানে উভয় দেশই নিজ নিজ ধর্ম ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া।

সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত অস্তিত্ব, কালচার, অবস্থান ধরে রাখতে উভয় দেশ শক্ত অবস্থানে। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বে নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখা দিয়েছে। ইসরাইলের সমর্থনে পর্যাক্রমে বেশি ইহুদি রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে আসছে এবং ফিলিস্তিন সমর্থনেও একইভাবে বেশি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এগিয়ে আসছে।

চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে তেল আবিবের পাশে অবস্থান নিয়েছে আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা অনেক দেশ।

তবে এই সংঘাত অবসানে ইসরাইল-ফিলিস্তিন আলাদা দুই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছে চীন। তবে এতে করে বিশ্ব পরিস্থিতি আরো নাজুক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনিতেই বিশ্ব করোনা পরিস্তিতি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সংক্রান্তে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল দশা। ফলে নতুন এ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো করুণ অবস্থায় নিয়ে যাবে। চলমান এ যুদ্ধ সংক্রান্তে সার্বিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পশ্চিমা বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত।

এ পরিস্থিতি নিরসনে ফিলিস্তিন জনগণের সার্বিক মুক্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান হতে পারে না। এছাড়াও জাতিসংঘের ২৪২ এবং ৩৩৮ নম্বর প্রস্তাবনা অনুসরণ করে দখলমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইলের পাশাপাশি অবস্থান এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে পারে। উভয় দেশকেই যুদ্ধ ও সংঘাতের সিদ্ধান্ত পরিহার করে শান্তি আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোকে এ শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকরী ব্যবস্থাসহ এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত