ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণার গুরুত্ব

ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা, সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণার গুরুত্ব

সমাজের কোনো সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির একমাত্র উপযুক্ত মাধ্যম হলো গবেষণা। গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশে সঠিক গবেষণা বা পূর্বপরিকল্পনার অভাবে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে সমাধান হয় না। গবেষণা ছাড়া কোনো দেশ সঠিক নিজেদের ইতিহাস জানতে পারে না। একটি দেশকে জানতে হলে, দেশের ইতিহাস ও সমস্যাদি গভীরভাবে বুঝতে হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐতিহাসিক জ্ঞান ও গবেষণা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা হলো তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য উপকরণ ও উৎসগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান। গবেষণার মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছানো সম্ভব। গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্ট জ্ঞান, চিন্তা ও আবিষ্কার একটি জাতিকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। এর ফলে মানবদেহে খাদ্যের উপকারিতা-অপকারিতা ও খাদ্যসংকট সমাধান, মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ইত্যাদি দিক সম্পর্কে জানা এবং সমাধানের পথ বের করা যায়। বেশি গবেষণানির্ভর দেশগুলো বেশি সমৃদ্ধশালী।

যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে গবেষণার মাধ্যমে ছোট-বড় সব সমস্যার সমাধান করা হয়। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, বিতরণ ও সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব সর্বাগ্রে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। আর এই নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অবদান রাখে। প্রকৃতির উপর সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণজাত বিক্ষিপ্ত তথ্য উপাত্তের পারস্পরিক অজানা সম্পর্ক আবিষ্কারের নাম গবেষণা। অজানাকে জানার কৌতূহলী আনন্দের নাম আবিষ্কার। আবিষ্কারের নেশা কাউকে কোনো কিছুতে বধ করতে পারে না। গবেষণার সাফল্য একজন গবেষককে আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দ দিয়ে থাকে। অতীতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণার ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল। হাল-আমলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে গবেষণার আগ্রহে অনেকটা ভাটা পড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। শিক্ষকদের মধ্যে জ্ঞান সৃষ্টি, বিতরণ কিংবা জাতির প্রতি মহান দায়িত্ব বোধ থেকে গবেষণার আনন্দ অনুভূত হয়।

বর্তমান বিশ্বের অস্থির পরিবেশ আমাদের রুগ্ণ সমাজকে পুনর্গঠনে আকাশচুম্বী লোভ লালসাকে ত্যাগ করলে গবেষণায় আমরা সমৃদ্ধশীল হতে পারি। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, ‘দরিদ্র্য শুধু অর্থের অভাব নয়, এটা মানুষের পূর্ণ শক্তির অবমূল্যায়নের ফসল।’ সত্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজ্ঞান কাজ করে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও ধর্মের কোনো সংঘর্ষ নেই। বরং উভয়ই পরস্পরের পরিপূরক। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই ঈশ্বরের ভাষা।’ দার্শনিক সক্রেটিস সত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য হেমলক পান করেছিলেন। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের বোঝানোর জন্য শিক্ষক আচার্য রায় হাড়ের উপাদান শিখাতে বুনসেন বার্নারের পুড়িয়ে ছাইকে মুখের মধ্যে দিয়ে বলতেন ক্যালসিয়াম ফসফেট। প্রফেসর কুমুদিনী কান্ত ব্যানার্জি রসায়ন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বিক্রিয়া শিখাতে গিয়ে এক চোখ হারান। গবেষণার মাধ্যমে ভালো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত হয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাদের বিজ্ঞান ও গবেষণা মানুষের কল্যাণের জন্য রেখে গেছেন। একজন ভালো গবেষক পারে একজন ভালো গবেষক তৈরি করতে।

প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. কে. এস কৃষাণ, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, স্যার আহমেদ ফজলুর রহমান, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ শিক্ষকের গবেষণা অবদানে সারা বিশ্ব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিনত। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। আচার্য বসুর অসামান্য গবেষণা কর্মের জন্য কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বসুকে এম.এ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ডি.এমসি ডিগ্রি প্রদান করে।

প্রফেসর সত্যেন বসুর কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাজটির উপর গবেষণা প্রকাশের পর প্রফেসর বসু কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও বসু উভয়ে গুরু শিষ্যর মতো ছিলেন। প্রফেসর বসু বহুদর্শী জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান, সাহিত্য, সংগীত ও রাজনীতিতে ভালো জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্ভীক, স্পষ্টবাদী ও অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক। তার প্রবন্ধ ও গবেষণা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে পরিচিতি করেছিল। বসুর মতে, ‘যারা বলেন, বাংলাতে বিজ্ঞান ও প্রবন্ধ লেখা সম্ভব নয়, তারা হয় বিজ্ঞান বোঝে না, না হয় বাংলা জানে না।’ গবেষণার গুরুত্ব এমনটাই যে, এক সময় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণা পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ ছিল বলেই তাদের সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হতো না। যথাপোযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করে।

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান রেশন চাষ ও ইক্ষু বালাই নিয়ন্ত্রণে, প্রফেসর বিধান চন্দ্র দাস প্রাণীর দেহাবয়ব সংরক্ষণে, প্রফেসর জোয়ারদার টিস্যু কালচার ব্যবহারে, প্রফেসর মঞ্জুর স্ট্রবেরি সফল চাষ ও স্বল্পমূল্যে কোল্ড স্টোরেজের উপযুক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ড. মাকসুদল হকের নেতৃত্বে জিনোম পদ্ধতির সাহায্যে ছত্রাক সহনশীল উন্নতমানের পাটজাত উদ্ভাবন, প্রফেসর একেএম আজহারুল ইসলাম, প্রফেসর অমরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী, প্রফেসর হাসান আহমেদ, প্রফেসর ড. অরুণ কুমার বসাক প্রমুখ শিক্ষক ও গবেষকদের অবদান পৃথিবীজুড়ে স্মরণীয়। অধ্যাপক হাসিনা খান ইলিশের জিনরহস্য ও পাটের জিনবিন্যাস আবিষ্কারক করে নাম করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় গবেষণার তীর্থভূমি। জার্মানির গটিজেন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ক্যান্টিনের ব্ল্যাকবোর্ডে গবেষণা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা হতো। অনেক সময় দেখা যেত বাইরের কেউ এসেও ক্যান্টিনের সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে নতুন নতুন গবেষণার দার উন্মোচিত হতো। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার স্বাধীন দেশের জন্য শুভকর নয়।’

গবেষণায় আর্থিক প্রণোদনা সঠিক ব্যক্তির কাছে যাচ্ছে কিনা ও গবেষণার সঠিক মূল্যায়ন ইত্যাদি আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের দেশে অনেক ভালো শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, গবেষক যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পঠন-পাঠন ও গবেষণাতে আশানুরূপ ফল পেতে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক, পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা গুণাবলী অতীব জরুরি। ভালো গবেষক ও গবেষণা দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। গবেষণা কাজ গবেষককে ব্যস্ত রাখে। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। মহান বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কোনোরকম গবেষণা অনুদান ছাড়াই বহুকষ্টে গবেষণা করে মানবকল্যাণে অবদান রেখে গেছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিশ্ববাজারে আমাদের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চিকিৎসাসহ সমাজের নানাবিষয়, বিশেষ করে ইতিহাস, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, খাদ্য ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গবেষণার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন।

২০৪১-এর উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে গবেষণা ও গবেষকদের কোনো বিকল্প নেই।

দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হয়েছে। একাধিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে এবং হচ্ছে। গবেষণায় বরাদ্দ, জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রে এই হার বেড়েছে। কিন্তু প্রথিযশা শিক্ষকের হার ও তাদের কর্ম সেরকম বাড়েনি। আমাদের যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবসম্পদ রয়েছে। আমাদের সন্তানদের তখনো মেধা ও সক্ষমতা ছিল, এখনো আছে। গবেষণায় উদাসীনতা মানে নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে অবহেলা করা। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আগ্রহ সৃষ্টি করে আগামী দিনের স্মার্ট উন্নত রাষ্ট্র গড়তে গবেষণায় হতে পারে অন্যতম হাতিয়ার।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত