ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিক্ষকদের পদোন্নতিতে অনীহা

দায়িত্ব নিতে না চাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়
শিক্ষকদের পদোন্নতিতে অনীহা

দেড় দশক পর পদোন্নতির জট খুলেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পাচ্ছেন। গত দুই মাসে তিন জেলায় পদোন্নতি পেয়েছেন পৌনে পাঁচশ’ শিক্ষক। শূন্য রয়েছে আরো প্রায় ২৯ হাজারের মতো পদ। নির্বাচনের আগেই প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদগুলো পূরণ করতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু যোগ্য বহু শিক্ষক পদোন্নতি নিতে চাইছেন না। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। উপজেলা পর্যায় থেকে পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষকদের তালিকাও (গ্রেডেশন) করা হয়েছে। যারা তালিকার উপরের সারিতে রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই পদোন্নতি নিতে চাইছেন না। এতে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। যারা পদোন্নতি নিতে আগ্রহী নন তারা বলছেন, পদোন্নতি নিলে তো কোনো লাভ নেই। বরং দায়িত্বের বোঝা কাঁধে চাপবে। স্কুলে নানা আয়োজন করতে হয়। উপজেলা শিক্ষা অফিসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, সেখানে লোকজন নিয়ে যাওয়া, স্কুল সংস্কার কাজে লোক ডাকাডাকি করতে হয়। তার সঙ্গে রেজিস্টার মেন্টেইন তো আছেই। আর সে কারণে শেষ বয়সে আর প্রধান শিক্ষক হতে আগ্রহী হচ্ছেন না তারা। পদোন্নতি নিতে না চাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, তাদের চাকরির বয়স শেষ পর্যায়ে। বয়স ও শারীরিক দিক বিবেচনায় পদোন্নতি নেওয়ার আগ্রহ নেই তাদের। কারণ প্রধান শিক্ষকের অনেক চাপ। দৈনিক ৫০-৬০টি রেজিস্টার মেইনটেইন করতে হয়। থাকে জবাবদিহি, ছোটাছুটিও করতে হয় অনেক। আবার পদোন্নতি পেলে এখন যে বেতন-ভাতা তারা পাচ্ছেন, তার চেয়ে খুব বেশি টাকা বাড়বেও না। তাই ঝামেলার মনে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৬ হাজার ৬২০টি। এর মধ্যে ২৯ হাজারের বেশি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে নিচ্ছেন সহকারী শিক্ষকরা। ২০০৯ সালে মামলার কারণে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদ পূরণ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে মামলা নিষ্পত্তি হয়। একই বছর প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। নিয়োগ ও পদোন্নতি পিএসসির অধীনে চলে যায়। আবারো বন্ধ হয়ে যায় পদোন্নতির মাধ্যমে শূন্যপদ পূরণ। তবে গত ৩ আগস্ট পদোন্নতির দুয়ার খোলে। চলতি বছর সব জটিলতা কাটিয়ে পদোন্নতির জন্য গ্রেডেশন তালিকা প্রস্তুত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ‘সমন্বিত গ্রেডেশন ব্যবস্থাপনা’ নামে সফটওয়্যার ব্যবহার করে এ কাজ করা হয়। পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষকদের এ গ্রেডেশন তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর তালিকা পিএসসিতে পাঠানো হয়। অনেক শিক্ষক বলছেন, দীর্ঘদিন তারা প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নে কাজ করছেন। সরকার যদি আমাদের এ দাবি মেনে নিত, তাহলে সবাই পদোন্নতি নিতে আগ্রহী থাকতেন। এখন সহকারী অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যাদের বেতন-ভাতা আগে থেকেই প্রধান শিক্ষক হয়ে যা পাবেন তারচেয়ে বেশি। ফলে অনেকে পদোন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। পিএসসি চূড়ান্ত তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠালে অফিস আদেশ জারি করা হয়। এমন সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া শেষের পর এখন পদোন্নতি নিতে চাইছেন না অনেক শিক্ষক। বাধ্য হয়ে তাদের আবেদন করতে নির্দেশ দেয় অধিদপ্তর। নির্দেশনার পর প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক পদোন্নতি নিতে চান না জানিয়ে আবেদন করেন। স্বাভাবিক অবস্থায় দায়িত্ব নিতে না চাওয়াটা অগ্রহণযোগ্য এবং দুঃখজনক। এ বয়সে ঘর সামলে আবার স্কুল সামলানো আমার জন্য কঠিন। এজন্য পদোন্নতি না নিতে আবেদন করা হয়েছে বলে দাবি অনেকের। বর্তমান বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেড পাচ্ছেন। যারা দীর্ঘদিন চাকরি করছেন, তারা ইনক্রিমেন্ট এবং অন্য সুবিধাসহ যে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, প্রধান শিক্ষক হলে তার চেয়ে খুব বেশি বাড়বে না। কারো হয়তো ৪০০ টাকা, কারো ৬০০ টাকা বাড়তে পারে। বেতন-ভাতা না বাড়ায় প্রধান শিক্ষকের পদকে বাড়তি ঝামেলা মনে করে কাঁধে নিতে চান না জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষকরা। কেউ কেউ বলছেন, চাকরির যে বয়স, ইনক্রিমেন্টসহ এখন যে বেতন পাচ্ছি, প্রধান শিক্ষক হলে আর ৪০০ টাকার মতো বাড়বে। অবসরের পরও বিশেষ বাড়তি কোনো সুবিধা যুক্ত হবে না। এজন্য পদোন্নতি নিয়ে প্রধান শিক্ষক হতে চাইনি। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটাকে বড় চাপ হিসেবে দেখছেন শিক্ষকরা। নির্বাচনে অনিয়ম হলে সেটার জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করার নিয়মও রয়েছে। এজন্য চাকরি জীবনের শেষ সময়ে ‘নিরীহ’ প্রকৃতির শিক্ষকদের অনেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি নিতে চাইছেন না। তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত জনিয়েছেন, ‘নীতিমালা মেনেই আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রেডেশন করেছি। নীতিমালার বাইরে যাওয়ার তো সুযোগ নেই। একটু ঝামেলা তো আছেই। সেগুলো সঙ্গে নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদগুলো পূরণ করা সম্ভব হবে।’ সব পেশায়ই দায়িত্ব থাকে। একজন শিক্ষক চাকরিজীবন শুরু করবেন, ধীরে ধীরে ওপরে উঠবেন। জ্যেষ্ঠ একজন শিক্ষক, যিনি ৩০ বছর চাকরি করছেন, এখন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বগুলো পালন করতে পারবেন না, সেটা তো তার অক্ষমতা ও অদক্ষতা। তবে যদি কারো ব্যক্তিগত ও শারীরিক সমস্যা থাকে, সেটা ভিন্ন কথা। স্বাভাবিক অবস্থায় দায়িত্ব নিতে না চাওয়াটা অগ্রহণযোগ্য এবং দুঃখজনক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত