ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার
দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না

একটি দুর্ঘটনা, সারাজীবনের কান্না এমনি একটি বিজ্ঞাপন আমাদের দেশের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচার হচ্ছে। বিজ্ঞাপনটির বক্তব্য একটু খেয়াল করে শুনলে বোঝা যাবে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কতটাই বেদনাদায়ক তা শুধু ব্যক্তি বিশেষ নয়, জাতির জন্যও বটে। নিরাপদ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে না উঠার কারণে প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ হতাহত হচ্ছে। যারা নিহত হচ্ছে তাদের দুর্ভোগ্যের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তার আয়ের ওপর যারা নির্ভরশীল তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। আয়ের কোনো উপায় না থাকলে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই তাদের সংসার পরিচালনা করতে হয়। আর যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন, তারা তো কোনো আয়-রুজি করতে পারেন না। তাদের সারাজীবন চিকিৎসা ব্যয়ের ঘানি টানতে হয়। একদিকে আয়ের পথ বন্ধ, আরেক দিকে আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যায় মেটাতে গিয়ে অন্যদের দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। যে পরিববারে কেউ সড়ক দুঘর্টনায় নিহত বা আহত হয়নি, তাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়- এই বেদনা কতটা কষ্টের। পরিবারের সারাজীবনের কান্না স্লোগানটি শতকরা একশ’ ভাগ ওই সব পরিবার অনুধাবন করতে পারে। তাই এখন ব্যক্তি ও সংগঠনিক পর্যায় থেকে দাবি তোলা হচ্ছে- সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা, সড়কে যেসব অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে তা সরকার ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা সামাজিক সংগঠনের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু যে মানুষই হাতাহত হয় তা নয়। যেসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়, সেগুলোর মূল্য কোটি কোটি টাকা। এসব অর্থের অপচয় ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মানুষ। বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। গতকাল দেশে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন উপলক্ষ্যে আগের দিন একটি বেসরকারি সংগঠন রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্যটি দিয়েছে। এ সময় সড়ক আইন ও বিধি অনুযায়ী দুর্ঘটনায় আহত সব নাগরিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান হয়। এ সময় দাবি করা হয় সড়ক-মহাসড়কে ই-ট্রাফিকিং সিস্টেম চালু করা গেলে সড়কে দুর্ঘটনা ৮০ শতাংশ কমে আসবে। অভিযোগ করা হয়, সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রোড সেফটি ইউনিট গঠিত হলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাদের কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই। দুর্ঘটনা থেকে জনগণকে রক্ষা করতে কোনো বাজেট নেই। মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক কিংবা গবেষণা নেই। ফলে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ আহত হচ্ছেন। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। এরমধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সি শিশু। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়।

বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্য মতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি। এক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক ক্ষতি হচ্ছে। বুয়েটের এআরআই-এর হিসাব বলছে, গত ৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা যদি নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় বেশি হয়, তাহলে সেটিকে জনসংখ্যা বোনাস বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে। পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে নিহতদের ৫১ শতাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মোট কথা হচ্ছে- সড়ক দুর্ঘটরা রোধে চালক, পুলিশ ও যাত্রীদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত