দুর্গাপূজার সার্বজনীনতা এবং সহাবস্থানের মননস্থল

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সব ধর্মের সহাবস্থানের দেশ বাংলাদেশ। উৎসব-আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। প্রাচীনকাল থেকেই একসঙ্গে বসবাস সবার। শরতের শুভ্র ভেলায় দেবী দুর্গার আগমন ঘটে। দেবী দুর্গা অসুর বিনাশের প্রতীক। দুর্গাপূজা সার্বজনীন। সময়ের পরিক্রমায় দুর্গাপূজা হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেই সার্বজনীনতা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে শরতের শুভ্রতার মতোই। যদিও মূল পূজার আনুষ্ঠানিকতা ভোরের শিশিরের সঙ্গে হেমন্তে শুরু হয়েছে। মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনী বার্তা ঘোষিত হয়েছে। দেবী দুর্গা সপরিবারে মর্ত্যে তার পিতৃগৃহে বেড়াতে এসেছেন। বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি ঘটবে। পৃথিবীতে সুর আর অসুরের দ্বন্দ্ব চিরকালের। অসুরের দাপটে সুর অর্থাৎ শুভ শক্তি যুগে যুগে কোণঠাসা হয়েছে। তারপর যখন পৃথিবী পাপে ভারাক্রান্ত হয়েছে, তখনই কোনো শুভ শক্তি পৃথিবীতে এসেছে। দেবী দুর্গা হলো সেই শুভ শক্তি। শত্রুদহনকালে তিনি অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা। তিনিই জগদীশ্বরী। হিন্দুশাস্ত্র দেবীপুরাণ, মৎসপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরান, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতে দেবী দুর্গা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এখন যেমন পৃথিবীতে ক্ষমতাশালীদের উল্লাস, ধর্ষকদের কুৎসিত হাসি, অসৎ মানুষের দাপটে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস এসবই মনুষ্যত্বের বাইরে। এরাই অসুর। মনুষ্যত্ব আর পশুত্বের লড়াই চলছে। তাতে মনুষ্যত্ব আজ কোণঠাসা। বহুযুগেও এরকম হয়েছে। পৃথিবীতে ক্ষমতাশালীদের দাপট বেড়েছে। মানুষ মরছে বোমার আঘাতে। শিশুরা প্রাণ হারাচ্ছে। এখন যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। এমন এক সময়েই দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটেছিল। সকল অন্যায় তার ত্রিশুলের আঘাতে পদতলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছি। তারপর একসময় তার পতন ঘটেছে কোনো একক শক্তি বা বহুশক্তির মিলিত রূপের কাছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে একটি ভালো শক্তি জাগ্রত হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীতে যখন আসুরিক শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তা বিনাশ করার প্রয়োজন হয়। তা যেমন বহুকাল আগেও হয়েছে, আজও হচ্ছে। অত্যাচারী রাজারা প্রজাদের ওপর অত্যাচার করেছে, অন্যদেশ আক্রমণ করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে। তারপর কেউ একজন এসেছে সেই অপশক্তিকে দমন করতে। এই অসুর বধ করার জন্যই পৃথিবীতে আবিভূত হন দেবী দুর্গা। সেই অসুরের নাম ছিল মহিষাসুর। নারী শক্তিতে যে অসুর অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিল। যারা দাপটে দেবতারা হয়েছিল স্বর্গ ছাড়া। নারী শক্তিকে যখন অবমাননা করা হয় তখন দেবী দুর্গা আবির্ভূত হন। শুরু হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। পূজা সনাতন ধর্মামলম্বীদের মাঝে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। মহামারির মধ্যেও শংকা থাকলেও পূজার আনন্দে মেতে উঠেছে সবাই। একটি উৎসব সবার মনেই আনন্দ বয়ে আনে। ঈদ, পূজা, বড়দিন বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা এসব আমাদের সবাইকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে। বাঙালির প্রাণ একই সূত্রে বাধা। তা সেসব মানুষের। যুগ যুগ ধরেই সহাবস্থানের মাধ্যমে বাঙালির একাত্বতা চোখে পরে। একজন আরেকজনের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূজা তাই একটি মেলবন্ধন।

পঞ্চমীতে দেবী দুর্গার খাটে ওঠার মধ্যেদিয়ে পূজার আনুষ্ঠিকতা শুরু। অবশ্য মহালয়ার মাধ্যমেই তা শুরু হয়েছে। দেবী আহ্বানের মধ্য দিয়ে এরমধ্যেই সেই আনুষ্ঠানিকতা শেষে পূজা শুরু হয়েছে। দেবী দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। পৃথিবীর মানুষ যখন কোনো অমানুষ বা অসুরের দ্বারা দুর্গতি বা অত্যাচারের শিকার হয়েছে, ততবার দেবী দুর্গা আবির্ভূত হয়েছে তাদের ধ্বংস করার জন্য। সনাতন ধর্মের আদি শক্তি দেবী দুর্গা। হিমালয়সম সিংহ তার বাহন। প্রলয়ংকরী সেই যুদ্ধে সিংহবাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১০ হাতে ১০ অস্ত্র নিয়ে দেবী অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দেবী দুর্গাসমগ্র নারী শক্তির প্রতীক। নারীদের অনুপ্রেরণা। নারীরা দুর্বল নয় বরং সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। অসুর কে বা কারা? যার মধ্যে সুর নেই অর্থাৎ নম্রতা, বিনয় ও মনুষ্যত্ব নেই সেই অসুর। এসব অসুররুপী মানুষগুলো আজ সমাজে বড় বেশি হয়েছে। তাদের দাপটে সুর অর্থাৎ সত্যিকারের মানুষগুলো কোণঠাসা। অসহায় নারীদের আর্তনাদ আকাশে বাতাসে। নারীর মধ্যেই সেই শক্তি আছে। যা এসব অসুরকে বধ করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে। এমন এক সময়ে মা আসছেন যখন পৃথিবীর শতাব্দির ক্রান্তিকাল চলছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর মহামারি চলছে। করোনাভাইরাসে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা লাখ লাখ। এখনো প্রতিদিন এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে আমাদের দেশে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন সব ঘটছে। ধর্ষণের শাস্তি সর্বোচ্চ মৃতুদণ্ড করা হয়েছে। তারপরও ধর্ষণ হচ্ছে। মোট কথা আসুরিক শক্তি সমাজে অশুভ ছায়া ফেলছে। এমনি এক সময় দেবী দুর্গার আগমন। নারী শক্তি যুগে যুগে জাগ্রত হয়েছে। আজও তাই হবে। নারী শক্তি ঠিক জেগে উঠবে। ১০ হাতে ১০ অস্ত্র নিয়ে দেবী দুর্গা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত। মহিষাসুর বধের যে কাহিনি আমরা জানি তাতে মহিষাসর ছিল এক অত্যাচারী অসুর। তার অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য পাতাল কম্পিত হয়েছিল। দেবতারা তাদের দেবলোক থেকে বিতাড়িত ছিল। স্বর্গলোক হারিয়ে তারা এসে উপস্থিত হয়, প্রধান ত্রিদেব অথাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেরের কাছে। তারপর তাদের এবং অন্যান্য উপস্থিত দেবতাদের তেজ থেকে আবির্ভাব হয় এক শক্তি। এই শক্তিই আদি শক্তি মহামায়া।

কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরান অনুসারে রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। এই সময়কালকে অকালবোধন বলা হয় কারণ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে এই সময় দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। দেবী দুর্গার আরো রুপ ও নাম রয়েছে। প্রতিটি রুপেই তিনি পুজিত হন। দেবী চন্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, নারায়ণী, কাত্যায়ণী প্রভৃতি বহুনাম রয়েছে তার। দেবী কালী তারই একটি জনপ্রিয় রুপ। এই রুপেও তিনি বহু ভয়ংকর অসুর বধ করেছেন। তার অষ্টাদশভূজা, ষোড়শভূজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজারুপে মূর্তি দেখা যায়। তবে দুর্গা নামে পরিচিত হওয়ার কারণ হলো তিনি দেবতাদের অনুরোধে দুর্গমাসুর নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন। পৃথিবী ব্যাপিত রেখেছেন যিনি তিনিই আদিশক্তি। দেবী দুর্গা হলেন দশভূজা। তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধারণ করেন। ব্রহ্মার বরে বলিয়ান মহিষাসুর কোনো পুরুষ দ্বারা বধ করার ছিল না। আর নারী শক্তিকে অবজ্ঞা করেছিল সেই মহিষাসুরও। তার ফলে তাকেও মরতে হয়েছে। দেবী দুর্গার চরণে তার পতন হয়। আজ আমরা সেই রুপকেই পূজা করি। মহিষাসুর তার পাপের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। রণভূমিতে একে একে মহিষাসুরের সেনাপতি চিক্ষু, চামুর নিহত হলে মহিষাসুর নিজেই আসেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তখনও তিনি দেবী দুর্গাকে অবজ্ঞা আর অবহলোই করছিলেন। তার ধ্বংস অনিবার্য ছিল। কারণ ক্ষমতার অহংকার, নারী শক্তিকে অবহেলা, অত্যাচার এসবই তার পতন ত্বরান্বিত করেছিল। পৃথিবীতে যারা অত্যাচারী, লোভ আর ক্রোধান্বিত থাকে তারাও ধ্বংস হয়। কোনো শক্তি আসে তাকে ধ্বংস করতে। প্রতিটি নারী এক একটি শক্তি স্বরূপ। তাদের মধ্যেও সেই বিনাশী শক্তি আছে। যা সব হিংস্র হায়েনাকে ধ্বংস করতে সক্ষম। যাই হোক সনাতন ধর্মামলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা এই করোনাকালেও মানুষের মুখে একটু হাসি বয়ে আনবে। মনে শক্তি জোগাবে। আর দেবীর কাছে প্রার্থনা থাকবে পৃথিবীকে পুরোপুরিভাবে করোনামুক্ত করে মানুষকে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে। আর সমাজে নারীর যে অপমান, অবজ্ঞা তার বিরুদ্ধে যেন নারীদের প্রতিবাদের শক্তি জোগায় এবং সমাজকে কুলষমুক্ত করে। দেবীর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই সব অসুরের বিনাশ হোক সমাজ থেকেই।

শরতে দেবীর আগমন ঘটে মর্ত্য।ে শরতে প্রকৃতি জেগে ওঠে নতুন রূপে। কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। এমন সময় দেবীর আগমনে ভক্তদের মনও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। বছরের ক্লান্তি দূর করে পূজায় অঞ্জলি দেয় ভক্তরা। ভক্তরা মঙ্গল কামনায় দেবীর স্মরণাপন্ন হয়। বাংলা মেতে ওঠে আনন্দে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বাঙালি মেতে থাকুক আনন্দে। বাংলা হয়ে থাক মিলনের প্রতীক।