গাজায় নির্বিচারে ইসরাইলি হামলা

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পরাভূত

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি হামলায় দিন দিন প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরা রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর গাজায় সংঘাত শুরুর পর থেকে ৪ হাজার ৮০০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৩ জনই শিশু ও ১ হাজার ১০১ জন নারী রয়েছে। ইসরাইলি হামলায় আরো ১৪ হাজার ২৪৫ জন আহত হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপরেই ফিলিস্তিনে ক্রমাগত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। হামাসের হামলায় ইসরাইলে ১ হাজার ৪০৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৫ হাজার ১৩২ জন। এদিকে জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গাজার হাসপাতালগুলোতে ইনকিউবেটরে থাকা অন্তত ১২০ নবজাতকের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। অপরদিকে এই যুদ্ধ আরো কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে বলে জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওভ গ্যালান্ট। তিনি বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, তা আরো কয়েক মাস ধরে চলতে পারে। তিনি বলেন, যুদ্ধ শেষে হামাসের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

আরব ও ইসরাইলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেটা এখনো চলছে। ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। এই সংঘাত বন্ধে শান্তির ফরমুলা হিসেবে বিভিন্ন সময় দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হলেও সেটিও বাস্তব রূপ পায়নি। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধানের বিষয়টি প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের এক অধিবেশনে। সে সময় বলা হয়, ইসরাইল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি। তবে একটা সময়ে এসে ঠিকই ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন উভয়পক্ষই দুই রাষ্ট্র সমাধানে ঐকমত্য হয়। ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরাইল শান্তিচুক্তির মাধ্যমে।

যেটা অসলো অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। এটা গঠনের সময়সীমা ছিল ৫ বছর। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলকে স্বীকার করে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়। অসলোতে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান মেনে নেওয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে, তার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। এমনকি ইসরাইলের বাইরে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়েরও কোনো সমাধান করা হয়নি। এই চারটি বিষয় হচ্ছে- দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত কোথায় কীভাবে নির্ধারণ হবে, জেরুজালেম কার অধীনে থাকবে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে থাকা ইসরাইলি বসতিস্থাপনকারীদের কীভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে এবং ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইসরাইলের ভেতরে থাকা যেসব ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তারা কীভাবে ফিরবেন। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ৫ বছরের মধ্যে একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের পর এগুলো আলোচনার ভিত্তিতে পরে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেটা আর কখনোই হয়নি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পরপরই-এর বিরোধিতায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ ইহুদিদের ওপর হামলা শুরু করে। অন্যদিকে ইসরাইলে একজন ইহুদি কট্টরপন্থির হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শান্তিচুক্তি করা দেশটির প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। এরপর ১৯৯৬ সালে ইসরাইলে ডানপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইল সরকারও আর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চায়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। এ সময় ইসরাইল মূলত নজর দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর এবং জেরুজালেমকে তারা ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে। সব মিলিয়ে ফিলিস্তিনে এখন যে ভৌগলিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবার আগে দরকার ভূখণ্ড। কিন্তু পশ্চিম তীর যেখানে ফিলিস্তিনের অংশ হবে সেখানে এখন কয়েক লাখ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বসবাস করছেন। এছাড়া জেরুজালেমকেও ইসরাইল তাদের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রও সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে ভৌগলিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখন আর বাস্তবসম্মত নয় বলেই অনেকে মনে করছেন। পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের ইহুদি বসতি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এটা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। গত তিন দশকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ। এছাড়া খোদ ইসরাইলের আইন অনুযায়ীই অবৈধ এরকম ইহুদি বসতিও আছে। বসতি সম্প্রসারণ এবং ইসরাইলের রাজনীতিতে-এর প্রবল সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রতিও এখন আর ইসরাইলের আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও হামাস এবং ফাতাহ দুই দলে বিভক্ত। তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কথা বলা বা শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার মতো একক এবং বিশ্বস্ত নেতা নেই। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এখন যে নতুন যুদ্ধাবস্থা, সেখানে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অচলাবস্থার পরিবর্তন কে করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্রকেই আবার এগিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শান্তির উদ্যোগ নিলে সেটা সফল হতে পারে।